পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
166

 ৭/৮ই অক্টোবরের সকাল ৮টার সময় আমরা সম্মিলিতভাবে শত্রুদের উপরি ঝাঁপিয়ে পড়ি। সুবেদার মঙ্গল মিয়া শালদা নদী গোডাউনের পরিখায় অবস্থানরত শত্রুদের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকে। সুবেদার বেলায়েত নদীর পার থেকে ওপারে শত্রুদের পরিখার উপর ভীষণভাবে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। নায়েক সুবেদার সিরাজ পাহাড়ী অবস্থান থেকে শত্রুদের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে। উভয়পক্ষের মধ্যেই প্রচণ্ড বিনিময় হতে থাকে। আমি আগেই পরিকল্পনা নিয়েছিলাম নদীর ওপারে পরিখাগুলি নষ্ট করে দিতে পারলে শত্রুরা আর টিকতে পারবে না। সে মতে নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ হোসেন আর-আর- এর গোলা পরিখার উপর ফেলতে থাকে এবং এতে কাজ হয়। আর-আর-এর দুটি গোলার আঘাতে নদীর পারে অবস্থিত চারটি পরিখার মধ্যে ২টি নষ্ট হয়ে যায় এবং শত্রুরা ঐ নষ্ট দুটি পরিখা ত্যাগ করে অন্য দুটিতে চলে যায়। সুবেদার বেলায়েত সঙ্গে সঙ্গে তার বাহিনীর কিছু লোক নিয়ে নদী সাঁতরিয়ে গিয়ে ভাঙ্গা পরিখায় অবস্থান নেয় এর ফলে শত্রুরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থানরত শত্রুসেনাদের সাথে গোডাউনে অবস্থানরত শত্রুসেনাদের কোন সংযোগ থাকে না। শত্রুরা আমাদের উপর মর্টার ও কামানের গোলা ফেলতে পারছিল না। এতে তাদের অনেক ক্ষতি হত, কেননা আমাদের সেন্যরা তাদের দুদলের মাঝে ঢুকে গেছে। শালদা নদী গোডাউনে অবস্থানরত বুঝতে পারে তাদের পক্ষে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়। অন্য দিক থেকে সাহায্য না পাবার ফলে তারা গোডাউনের পার দিয়ে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনে তাদেও অবস্থানে পালিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গল মিয়া শালদা নদী গোডাউনটি দখল করে নেয়। দুপুর ১১টার সময় শত্রুদের একটি অয়ারলেস থেকে ম্যাসেজ আমি ধরি। তাতে তারা কতৃপক্ষকে জানায় মুক্তিবাহিনীর ১টা ব্যাটালিয়ান তাদের আক্রমণ করেছে। এ মুহূর্তে তাদেও পক্ষে আর এ ঘাঁটিতে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।

 এ ম্যাসেজ ধরার পরে আমার মনোবল বেড়ে যায়। আমি আমার শত্রুদের আরও তীব্রভাবে তাদের উপর আক্রমন করার নির্দেশ দেই। আমি বুঝতে পারছিলাম তাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। শত্রুরা এ ঘাঁটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে যদি আমরা আক্রমণ চালিয়ে যাই। কিছুক্ষণ লড়াই চলবার পর শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত শত্রুসেনারা ধীরে ধীরে রেললাইন বরাবর পরিখা দিয়ে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনে তাদের ঘাঁটিতে পালিয়ে যেতে থাকে। আমি এবং আমার বাহিনী পরিখাতে অবস্থান নিয়ে পলায়নপর শত্রুদের উপর গুলি চালাতে থাকি। একজন পাকসেনার কথা আমার মনে পড়ে। সে ধীরমন্থর গতীতে একটি পরিখা থেকে অন্য পরিখাতে যাচ্ছিল। আমি তার উপর গুলি চালাই। দেখি আবার কিছুক্ষণ পর উঠে ধীরমন্থর গতিতে আবার এগিয়ে যাচ্ছে, আবার গুলি চালাই। এভাবে ২/৩টি পরিখা পার হবার পর সে আর যেতে পারেনি। আমার মনে হয় আমাদের আক্রমণের সময়ই সে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল যার জন্য সে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে পারেনি।

 এরপর আমরা সমগ্র শালদা নদী এলাকা দখল করে নিয়ে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলতে থাকি যেন শত্রুরা আক্রমণ করে শালদা পুনর্দখল করে নিতে না পারে।

 এরপর শত্রুরা নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘাঁটি থেকে মর্টার ও কামানের গোলা বৃষ্টির মত আমাদের অবস্থানে ফেলতে থাকে। ইতিমধ্যে ভারতীয় বাহিনীর লেঃ জেনারেল সগৎ সিং আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য মন্দভাগে আসেন। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই।

 এর মধ্যে শত্রুরা আমাদেরকে আক্রমনের জন্য শালদা নদী গোডাউনের কাছে সমাবেশ হচ্ছে খবর পেয়ে সুবেদার বেলায়েত সে স্থানে যান। রেকি করার সময় একজন প্যারা-ট্রুপস এর শত্রুসেনা একটি গাছের আরাল থেকে তাকে গুলি করে গুরুতরভাবে আহত করে। জেনারেল সগৎ সিং-এর সাথে দেখা করে ফেলার পর আমি এ খবর পাই। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিকিৎসা করার জন্য সেক্টর-২-এর হাসপাতালে পাঠানো হয় কিন্তু পথিমধ্যে সে মারা যায়। তার মত বীর সৈনিকের মৃত্যুতে আমি মর্মাহত হয়ে পড়ি। তার মত বীরের মৃত্যুতে আমাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ একজন মহান বীরকে হারায়।