পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
183

একটানা পথ চলে গেছে সম্মুখ বরাবর। আমাদের এ অভিযানে ১০ বেঙ্গলের জোয়ানেরা ছাড়া মিত্রবাহিনী জোয়ানদের পূর্ণ ও সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। যদিও সমস্ত কিছু পরিচালনা ও পরিকল্পনা করার দায়িত্ব আমরাই নিয়েছিলাম। অবশ্য এর কারণ ছিল যে, বাংলাদেশের সমস্ত পথঘাট ও প্রয়োজনীয় অনেক কিছু আমাদেরই জানা।

 বেলা বাড়ছে। আমরা সবাই এগিয়ে যাচ্ছি। নিশ্চিন্তে চলার অবকাশ ছিল না। পথে দুশমনের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অভিযানে বিলম্ব হচ্ছিল। আমরা এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলাম না। সব বাধা প্রতিরোধ ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম গন্তব্যস্থল অভিমুখে। থেমে থাকলে চলবে না। অভিযান সফল করতেই হবে।

 ১৩ই ডিসেম্বর। আমরা তখনো গন্তব্যস্থলের অনেক দূরে। আর ৪ মাইল দূরেই কুমীরা। এখানেও শত্রুরা বেশ শক্তিশালী ঘাঁটি করে আছে। আমরা বেলা প্রায় ১২টায় কুমলার অদূরে এসে পৌঁছলাম। এরপর আর সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হলো না। কুমীরায় অবস্থিত শত্রুদের ঘাঁটি থেকে আমাদের উপর প্রবল আক্রমণ শুরু হলো। আমরাও প্রবলভাবে ওদের এ আক্রমণের জবাব দিয়ে চললাম। কিন্তু সামনে অগ্রসর হওয়া সমীচীন মনে করলাম না। তখন মিত্রবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার আনানস্বরূপের তরফ থেকে আমার কাছে আর একটি বিকল্প আদেশ এলো। আনানস্বরূপ আমাকে বললো, 'তুমি ১০ম বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানী ও মিত্রবাহিনীর দলকে রেখে কুমীরা পাহাড় পার হয়ে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা হয়ে যাও।”

 আমি সেই অনুযায়ী ১০ম বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানী লেঃ দিদারের অধীনে রেখে এবং মিত্রবাহিনীর কোন সহযোগিতা ছাড়া আমার ১০ম বেঙ্গল নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারেই কাজ শুরু করতে মনস্থ করলাম।

 আমরা যখন ফেনী থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হয়েছিলাম সে সময়েই চতুর্থ বেঙ্গলের একটি দল ক্যাপ্টেন গফফারের অধীনে পরিচালিত হয়ে চিটাগাং-রাঙ্গামাটি রোড ধরে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা হয়ে গিয়েছিল। আমরা কুমীরা পাহাড় পার হয়ে গোপনে হাটহাজারী আক্রমণের পরিকল্পনা নিলাম। সন্ধ্যার সাথে সাথে আমরা সব ঠিক করে রওনা দিলাম। ডিসেম্বরের শীতের সন্ধ্যা। অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে শীতের মাত্রাও যেন বাড়ছিল। কিন্তু সেসব ভাববার অবকাশ ছিল না। এ রাতের অন্ধকারেই, শীতের সাথে মিতালী পাতিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পাড়ি দিতে হবে অচেনা অজানা পথ। এ পথে আমরা একেবারেই নতুন। পাহাড়ী বন্ধুর পথ। কোথাও ঢালু, কোথাও উঁচু-নীচু। কোথাও বা ছোট ছোট খাল। চারিদিকে গাছগাছালির ভিড়। অন্ধকার যেন তাই আরো নিবিড় লাগছিল। সাথে আমাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র। নিজেদের চলতেই কষ্ট হচ্ছিল। তার উপর এসব ভারী বোঝা নিয়ে চলা বড়ই দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু তবুও অতিক্রম করতেই হবে আমাদের।

 আমরা তাই পথ চলছি। অতি কষ্টে নিঃশব্দে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক। ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক। মাঝে মাঝে পথ ভুলে যাচ্ছিলাম। আবার পিছিয়ে এসে চলছিল সঠিক পথে। এ পাহাড়ী পথে কোথাও তেমন মানুষজনের সাড়া পেলাম না। শুধু মাঝে মাঝে দু'একটা পাহাড়ী কুটিরে কিছু লোকের দেখা পেলাম। তাদের কাছ থেকে পথ নিচে নিয়ে পথ চলতে লাগলাম। ক্রমশঃ রাত বাড়ছে। ঠিক কত জানি না। ক্ষুধায়, পথশ্রমে সবাই ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু অন্ধকারে অচেনা, অজানা স্থানে কোথায় নেব বিশ্রাম। তাছাড়া এখন সময় নেই বিশ্রামের।

 রাত শেষ হলো। চারিদিকে ভোরের আলো ফুটছে। গাছগাছালির পাতার ফাঁকে ফাঁকে ভোরের সূর্যের আলো পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল। ভোরের পাখীদের কলতানে বনাঞ্চল মুখরিত হয়ে উঠছিল। দিনের আলোয় সবাই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পথঘাট চলতে আর চিনতে কিছুটা সুবিধা হবে হয়তো এবার। তাই মিনিট দশেক সবাই একটু বিশ্রাম নিলাম।