পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
199

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫। ৩নং সেক্টরের ও ‘এস’ ফোর্সের যুদ্ধ বিবরণ সাক্ষাৎকারঃ মেজর জেনারেল কে, এম, শফিউল্লাহ[১] ....১৯৭১

 তেলিয়াপাড়া পতনের পর সিলেটের মনতলা হতে সিংগারবিল পর্যন্ত এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এ এলাকা থেকে আমরা গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছেলেদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিভাবে ক্ষতি করতে হবে সেভাবে টাস্ক দিয়ে পাঠাতাম।

 যখন আমরা এ কাজে ব্যস্ত ছিলাম তখন আমাদের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওসমানী সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টা সেক্টরে বিভক্ত করে এক নির্দেশ পাঠান। সেই নির্দেশ মোতাবেক আমার সেক্টরে নামকরণ করা হয় ‘তিন নং সেক্টর’। যে এলাকার যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমার উপর দেওয়া হয়েছিল, সে এলাকাগুলো ছিল সীমান্ত এলাকা-উত্তরের সিলেটের চূড়ামনকাঠি (শ্রীমংগলের কাছে) এবং দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিংগারবিল। অভ্যন্তরীণ যে সকল এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমার উপর দেওয়া হয়েছিল সেগুলো হলো, সিলেটের মৌলভীবাজার সাবডিবিশন-এর কিয়দংশ, সম্পূর্ণ হবিগঞ্জ মহকুমা নবিনগর থানার কিছু অংশ বাদে সমস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার এবং নারায়ণগঞ্জ মহকুমার আড়াইহাজার এবং বৈদ্যরবাজার থানা ছাড়া সমস্তটা, ঢাকা শহর ছাড়া ঢাকা নর্থের সমস্তটা, কিশোরগঞ্জ মহকুমা এবং গফরগাঁও এবং ভালুকা থানা। এইগুলি ছিল আমার অভ্যন্তরীণ সেক্টরের এলাকা। এ এলাকা ছাড়াও ঢাকা শহর এবং নারায়ণগঞ্জ শহরের বিভিন্ন গেরিলা তৎপরতায় আমি আমার গেরিলা যোদ্ধাদের পাঠিয়েছিলাম। এভাবে এলাকা ভাগ করে দেয়ার পর আমরা বাংলাদেশের ভেতর স্থানে স্থানে গেরিলা বেইস তৈরী করি। সেখানে কিছুসংখ্যক নিয়মিত বাহিনীর লোক পাঠাই যেন তারা গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত পরিচালনা করতে পারে। আমার এলাকার যে সমস্ত জায়গাতে গেরিলা বেইস তৈরী করেছিলাম, তা ছিল সিলেটের চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ ও বানিয়াচংগে। একটাই ছিল সিলেটে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার নাসিরনগর, সরাইল, মুকুন্দপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং নবীনগরে একটি করে বেইস। কিশোরগঞ্জে যেসব বেইস তৈরী করি সেগুলো হল কুলিয়ার চর, বাজিতপুর, কটিয়াদি, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর এবং কিশোরগঞ্জে-প্রত্যেকটি জায়গায় একটি করে বেইস তৈরী করি। ঢাকা জেলাতে যেসব বেইস তৈরী করি তা-রায়পুরা, শীতপুর, নরসিংদী, কাপাসিয়া, মনোহরদি, কালিয়াকৈর, জয়দেবপুর এবং কালীগঞ্জ। ময়মনসিংহের গফরগাঁও এবং ভালুকাতে একটি করে গেরিলা বেইস তৈরি করি।

 এসব বেইস-এ ট্রেনিং দিয়ে ছেলেদের পাঠাবার জন্য আমরা শরনার্থী ক্যাম্প থেকে ছেলেদেরকে রিক্রুট করতাম। ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লা জেলার অভ্যন্তরে যেসব বেইস তৈরী করেছিলাম যেসব বেইস-এ গেরিলা তৎপরতা চালাতে বিপুলসংখ্যক ছেলে ট্রেনিং-এর জন্য আসত। এসব জেলা থেকে যেসব তরুণ ছেলেরা ট্রেনিং নেয়ার জন্য আসত তাদের সংখ্যা এত বেশী ছিল যে, তাদের সবাইকে ট্রেনিং দেয়া আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ত। তাই তখন রিক্রুটমেণ্ট-এ যেতাম। এতে বেশ কিছুসংখ্যক ছেলে সিলেক্ট না হতে পেয়ে নিরাশ হয়ে যেত। কিন্তু সিলেট জেলায় আমাকে বেশী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যখন এসব বেইসগুলোতে হাজার হাজার ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা পৌঁছে গিয়েছিল, তখনও আমি সিলেট জেলার বেইসগুলোতে গেরিলা পাঠাবার জন্য কোন ছেলেকে রিক্রুট করতে পারিনি। দু’ চারজন যারা রিক্রুট হয়েছিল তারাও জেলার অভ্যন্তরে তৎপরতা চালাবার সাহস পায়নি। অবশেষে আমরা বেইস তৈরী করার জন্য অস্ত্রের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। গেরিলা যুদ্ধে সমস্ত নীতির মধ্যে অন্যতম নীতি হল যে, গেরিলা যুদ্ধকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য জনগণের সাহায্যে একান্ত প্রয়োজন কিন্তু সিলেটে এ সমর্থনের বিশেষ অভাব ছিল। তাই প্রথম পর্যায়ে আমাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলার হয়তবা পাক সেনাবাহিনী কর্তৃক ধৃত হয়েছে অথবা জনগণ দ্বারা ধৃত হয়েছে। যারা ধরা পড়েছিল তারা


  1. ১৯৭১-এর মার্চে ২য় রেজিমেণ্টে মেজর পদে সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড হিসাবে কর্মরত ছিলেন।