পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
205
কালেঙ্গা জঙ্গলে এ্যামবুশ-২৪শে সেপ্টেম্বরঃ

 সিলেটের অভ্যন্তরে যে সমস্ত গেরিলা পাঠাতাম, তাদেরকে এই কালেঙ্গা জঙ্গলের মধ্য দিয়েই পাঠাতাম। পাক সেনাবাহিনী এ খবর পেয়ে কালেঙ্গা জঙ্গলে তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। তারা যাতে নিরাপদে চলাফেরা না করতে পারে সেজন্য কালেঙ্গা রেস্ট হাউসের পাশে কিছুসংখ্যক এণ্টি-পারসোনাল মাইন পুঁতে রাখা হয় এবং এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার জন্য লোক নিয়োগ করি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কিছু সৈনিক সেপ্টেম্বর মাসের ২০/২১ তারিখে কালেঙ্গা জঙ্গলে আসে এবং কিছুক্ষণ ঘোরাফেরার পর তারা রেস্ট হাউসের দিকে ফিরে যায়। রেস্ট হাউসের দিকে ফিরে যাবার সময় তাদের পায়ের চাপে দু'খানা মাইন ফেটে যায় এবং তাতে একজন মারা যায় ও দু'তিনজন আহত হয়। পাকসেনারা সেখান থেকে সিন্দুরখানের দিকে চলে যায়। পরদিন বেশ কিছুসংখ্যক লোক আসে সে মাইন পরিষ্কার করা এবং সেখানে ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা করার জন্য। ঐ নি যদিও আমাদের লোক সেখানে ছিল, সেদিন তাদের কোন বাধা দেয়া হয়নি। আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর মারাত্মক আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

 ২৪শে সেপ্টেম্বর আমাদের সৈনিকরা সিন্দুরখান-কালেঙ্গা রাস্তার উপর ছোট ছোট পাহাড়ের উপর এ্যামবুশ লাগিয়ে শত্রুর অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকে। ঐদিন পাকসেনারা বেশকিছু লোকসহ কালেঙ্গার দিকে আসছিল। তাদের দলের সবচেয়ে আগে ছিল প্রায় ২০/২৫ জন বাঙ্গালী রাজাকার। তাদের পেছনেই ছিল পাকিস্তানী সৈন্য। দু'দিন আগে যখন তারা এখানে ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা করার জন্য এসেছিল তখন কোন বাধা পায়নি। তাই ২৪ তারিখে যখন তারা কালেঙ্গার দিকে আসছিল সেদিন বেপরোয়াভাবেই অগ্রসর হচ্ছিল। আমাদের সৈনিকরাও তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে বসেছিল। রাজাকারের দল যখন আমাদের ফাঁদের ভিতর চলে আসে তখন তাদের কিছু বলা হয়নি। আমাদের সৈনিকরা শুধু পাকসেনারা অপেক্ষায় ছিল। সে জায়গাতে আমাদের এ্যামবুশ ছিল সেখান থেকে পাকসেনাদের অগ্রসরমান সব সৈনিককেই দেখা যাচ্ছিল, তাই রাজাকারদের দল আমাদের ফাঁদের ভিতরে থেকে যখন বেরিয়ে যায় তখন তাদের কিছু করা হয়নি। যখন পাকিস্তানী সেনারা আমাদের ফাঁদের ভিতরে ঢুকে পড়ে তখনি আমাদের সৈন্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং চারদিক থেকে তাদের উপর গোলাগুলি শুরু করে। তাদের দলটি বিস্তীর্ণ এলাকার উপর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এতে সকল সৈনিক আমাদের ফাঁদের ভিতর পৌঁছতে পারেনি। যারা ভিতরে প্রবেশ করেছিল, তারা প্রায় সবাই নিহত হয়। পেছনের যে সমস্ত পাকসেনা আমাদের ঘেরাওয়ের বাইরে ছিল, তারা তাদের বিপদগ্রস্থ সঙ্গীদের বাঁচাবার উদ্দেশ্যে আমাদের সৈনিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। আমরা যেহেতু পরিখা খনন করে বসেছিলাম তাই শত্রুদের গোলাগুলি আমাদের কোনরূপ ক্ষতি করতে পারেনি। এমন সময় হঠাৎ নায়েক আবদুল মান্নান পরিখা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে এবং “জয়বাংলা” বলে চীৎকার করে ওঠে এবং এই বলে সামনে অগ্রসর হয় যে জীবিত পাকসেনাকে ধরে ক্যাপ্টেন সাহেবের (ক্যাপ্টেন আজিজ) সামনে হাজির করব এবং দেখব ক্যাপ্টেন সাব আমায় গলায় মারা পরান কিনা। তার দিন ফুরিয়ে গিয়েছিল হয়ত তাই সে এরূপ বেপরোয়াভাবে পরিখা থেকে বেরিয়ে আসছিল। সে কিছুদূর অগ্রসর হবার পরই পাকসেনার মেশিনগানের গুলি তার বক্ষ এবং মস্তক ভেদ করে এবং সে সেখানেই কলেমা পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

 এ যুদ্ধে পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ ৬১ জন সৈনিক নিহত হয়। এছাড়া কিছুসংখ্যক আহত হয়েছিল। কিন্তু তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

মনোহরদী অবরোধ-২১শে অক্টোবরঃ

 অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়াতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের ছোটখাটো দলকে (ডিটাচমেণ্ট) থানা হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল। প্রত্যেক থানা হেডকোয়ার্টারের সৈন্যসংখ্যা এক কোম্পানীর কম রাখতে সাহস পেত না। এক কোম্পানী করে সৈন্য প্রত্যেক থানাতে দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছিল না। কারণ, কোন কোন স্থানে সৈন্যসংখ্যা এক ব্যাটালিয়নেরও বেশী রাখতে হত।