পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
211

ডোবার ভিতর লাফিয়ে পড়ি। আমার পরনে ছিল অলিভ গ্রীন পোশাক। ডোবায় ছিল কাদা। অলিভ গ্রীন আর কাদা মিলে দেখতে প্রায় মিলিশিয়া পোশাকের মতোই হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন দেখছিলাম যে গাড়ী থেকে প্রায় ২০/২৫ জন লোক নেমে ঐ গ্রামের চারদিকে অবস্থান নিচ্ছে। আমি যে ডাবার মাঝে ছিলাম তা তারা দেখেছিল। বুঝতে পারলাম যে কোন মুহূর্তে তারা আমাকে গুলি করবে। ভাবছিলাম কাদাপূর্ণ ডোবার ভিতর মরার চেয়ে আর একবার চেষ্টা করে দেখা যাক। তাই আমি ডোবার মধ্য থেকে উঠেই তাদের মধ্য দিয়েই চলে যাই। এবং এক বাড়িতে ঢুকে পড়ি। ঐ বাড়িতে একটা খোলা ঘরের ভিতরে ঢুকে সেখানে বসে পড়ি এবং মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকি। কারণ সে বাড়ির চারিদিকেই পাকিস্তনী সৈন্য মোতায়েন ছিল। আমি যখন ঘরের ভিতর বসেছিলাম তখন আমাদের সৈন্যরা পাকিস্তানী বাহিনীর দুই দিক থেকে আক্রমণ করে। বেলা তখন প্রায় ৪টা।

 এ আক্রমণে পাকিস্তানী সৈন্যদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পিছনে হটতে থাকে। পশ্চাদপসরণকালে সবাই ধরা পড়ে। এ খণ্ডযুদ্ধে পাকিস্তানীদের ২৫ জন মারা যায় এবং ঐ দিন ১১ জনকে জীবিত অবস্থায় ধরা হয়। পরের দিন আরো তিনজনকে ধরা হয়। আমাদের দুইজন শহীদ হয় এবং ১১জন আহত হয়। এই খণ্ডযুদ্ধে যারা সাহসের পরিচয় দিয়েছিল তারা হলঃ ১। লেফটেন্যাণ্ট নজরুল ইসলাম। ২। নায়েক মুস্তফা আলী। ৩। হাবিলদার আবুল কালাম। ৪। হাবিলদার রফিক (শহীদ)।

 এ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন হাবিলদার রফিক এবং সিপাহী মুজিবর রহমান। আমাদের ডাক্তার লেফটেন্যাণ্ট মইনুল ইসলাম আহত হন। তাই আহতদের চিকিৎসা সেখানে করতে না পারায় আমি আহতদের পাসিস্তানীদের ট্রাকে (আমাদের দ্বারা দখলকৃত) করে চান্দুরার দিকে নিয়ে যাই। সাথে কোন ড্রাইভার না থাকায় আমি নিজে গাড়ী চালিয়ে চান্দুরার দিকে নিয়ে যাই। এ ঘটনা এতো অল্প সময়ের মধ্যে ঘটেছিল যে, পেছনে থেকে যারা অগ্রসর হচ্ছিল তারা ঘটনাস্থলে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারেনি। আমি যখন গাড়ী চালিয়ে চান্দুরার দিকে যাচ্ছিলাম তখন আমাদের লোক মনে করছিল যে শত্রুরা পালিয়ে যাচ্ছে। তখন তারা আমাদের উপর মেশিন গান দিয়ে গুলিবর্ষণ করে। আল্লাহ অপার করুণায় তাদের মধ্যে কেউ হয়ত অমাকে চিনতে পারে এবং গুলিবর্ষণ বন্ধ করে। আমি কোম্পানী লোকদের ভিতর দিয়ে গাড়ী চালিয়ে যখন চান্দুরার দিকে যাচ্ছিলাম তখন পেছনের সর্বশেষ যে কোম্পানী (আমাদের) ছিল তারা ভেবেছিল যে শত্রু এই কোম্পানীর হাত থেকেই রক্ষা পেতে সক্ষম হয়েছে। তাই তারাও আমার উপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে গাড়ীর উইগু স্ক্রীন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু এবার খোদার অসীম কৃপায় ঠিক পূর্বের মত বেঁচে যাই। তারপর চান্দুরায় পৌঁছে আহতদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করি। যেহেতু সবাই গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল, তাই খুব দ্রুত তাদের হাসপাতালে পৌঁছাবার ব্যবস্থা নেই। সবাই স্ট্রেচারে করে আগরতলা পাঠিয়ে দেই।

 ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার নাসিম এ খণ্ডযুদ্ধে আহত হন। তাঁর পরবর্তী সিনিয়র সুবেদ আলী ভূঁইয়ার উপর থেকে আমার আস্থা চলে গিয়েছিল এজন্য যে, সে রোড ব্লক করা সত্বেও কিভাবে শত্রুরা আমাদের পেছনে চলে আসলো? আমার রিয়ার হেড কোয়ার্টার এর সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না। কারণ এ যুদ্ধে অয়ারলেসটাও নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমি অন্য কোন অফিসার এনে এ ব্যাটালিয়নের কমাণ্ডার পদে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

 এ ব্যাটালিয়নে শতকরা ৮০জন সৈনিক ছিল নতুন শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং এটাই ছিল খণ্ডযুদ্ধের মাধ্যমে তাদের প্রথম অপারেশন। যুদ্ধে ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার আহত হওয়াতে সৈনিকদের মনোবল একটু দমে যায়। আমি আবার পাইকপাড়ার দিকে ফিরে আসার সময় লে, নাসিমকে ব্যাটালিয়ন নিয়ন্ত্রণে রাখতে নির্দেশ দিয়ে আসি এবং তাকে এও বালে আসি যে আমি অফিসার নিয়ে আসছি। পাইকপাড়ায় পৌঁছে আমি এ সিদ্ধান্ত নেই যে যত শীঘ্র হোক আমাকে পেছনে যেতে হবে এবং সেখান থেকে অফিসার আনতে হবে। আমি পেছনে না গেলে হয়তো অন্য কোন অফিসারকে আনা সম্ভব নয়। কারণ তারা কোন না কোন কমাণ্ড-এ আছে। এই অসুবিধার জন্য আমি সেদিন রাতেই রিয়ার হেডকোয়ার্টারে চলে যাই এবং সেক্টর কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর