পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
243

একটি নদী চলে গেছে। এবং হিমুর আগে বেশকিছু উচু জায়গা আছে। আমাদের পক্ষে এগোনো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাছাড়া হিমু যাবার পুলটা পাকিস্তানীরা উড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে বলা হল হিমুর পেছন দিক থেকে শত্রুসৈন্যকে আক্রমণ করতে এবং যেভাবে হোক হিমু শত্রুমুক্ত করে হরিপুরের উপর আক্রমণ চালাতে।

 খাওয়া-দাওয়া করে গ্রাম থেকে দ'জন গাইড নিয়ে চললাম হিমুর উদ্দেশ্যে। সারারাত নদী-খাল-বিল পার হয়ে পৌঁছলাম আটগ্রাম বলে একটি গ্রামে। সেখান থেকে হিমুর দূরত্ব প্রায় দু'মাইল। আটগ্রাম পৌঁছলাম ভোর চারটায়। গ্রামের পাশে নদী পার হতে হবে অনেক কষ্টে। দুটো নৌকা যোগাড় করা গেল। ওপারে সবাই পৌঁছলাম। ওপারে প্রায় ৭০০/৮০০ গজ দূরে খোলা মাঠ, তার উপরে অনেকগুলো উঁচু টিলা, যা পুরো আটগ্রাম গ্রামকে ঘিরে রেখেছে। সকাল হতে চলেছে। দেখলাম হিমু পর্যন্ত পুরো খোলা মাঠ। চিন্তা করলাম দিনের বেলা এই খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে যাওয়া সমীচীন হবে না। তাই সবাইকে বললাম আজকের দিনটা আটগ্রামে কাটিয়ে দিই। সন্ধ্যার সময় হিমুর পথে যাত্রা করা যাবে। ভারতীয় গুর্খা সৈন্যদের সংগে বেতার যোগাযোগ করতে পারলাম না। যাই হোক আবার সবাই মিলে নদী পার হয়ে আটগ্রামে ফিরে আসলাম। আমার সৈন্যদের কে কোথায় জায়গা নেবে পুরো হুকুম দেবার সময় পেলাম না। বেলা প্রায় আটটা হবে। পাকিস্তানীদের দিক থেকে শুরু হল আমাদে উপর ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষণ। সঙ্গে আরম্ভ হল আমাদের উপর মেশিনগান এবং এল-এম-জি'র গোলাবর্ষণ। সৈন্যরা নিজের নিজের জায়গায় অবস্থান নিল। কিছুই করার নেই একবারে শত্রুর মুখে পড়ে গেছে। কিন্তু বুঝলাম একেবারে আচানক শত্রুর গোলাগুলিতে আমার সৈন্যরা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে।

 আটগ্রাম ছোট গ্রাম। বৃষ্টির মত গোলাগুলি হচ্ছিল। আমাদের এমন কিছুই করবার নেই। চিন্তা করলাম যদি আটগ্রাম থাকি তাহলে আমরা সবাই মারা যাব। কারণ পাকিস্তানীরা আমাদের জায়গা জেনে ফেলেছে। তাই সবাইকে বললাম যে বেভাবে পারে পেছনে দু'তিন মাইল দূরে অন্য আর এক গ্রামে চলে যেতে। যাবার সময় আহতদের নিয়ে যাবার জন্য বলা হল। ডাক্তার নজরুলকে বললাম যারা শহীদ হয়েছে তাদের কবরের ব্যবস্থা করার জন্য। আমরা সবাই চললাম গ্রামের দিকে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ দয়া ছিল। যখন আমরা আটগ্রাম ছেড়ে পেছনের গ্রামে যাচ্ছিলাম তখন আমাদের কেউ শহীদ বা আহত হয়নি। যদিও আমাদের উপর গোলাগুলি হচ্ছিল। একটি গুলিও আমাদের উপর লাগেনি। যখন সবাই এসে পৌঁছলাম তখন দেখলাম আমার ১১ জন ছেলে শহীদ হয়েছে এবং পাঁচজন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। সবার সাথে আলাপ করে বুঝলাম সবাই ঘাবড়ে গেছে। ভাবলাম একটা দিন পুরো বিশ্রাম নেয়া উচিত। গ্রামের লোকেরা আমাদের যথেষ্ট খাতির করেছে।

 ১২ই ডিসেম্বরে বিকেল বেলা হিমু থেকে খবর পেলাম পাকিস্তানীরা চলে গেছে চিকনাগুল চা বাগানের দিকে। সোজা চিকনাগুল চা বাগানের দিকে যাবার পরিকল্পনা নেয়া হল। চারধার থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসতে লাগল। বিনা বাধায় চিকনাগুলে পৌঁছলাম। ভারতের গুর্খা ব্যাটালিয়নের সঙ্গে তখন পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরের দিন রাস্তায় দেখা হল গুর্খা ব্যাটালিয়নের সি-ও'র এর সঙ্গে, ঠিক হল রাস্তার ডানদিক দিয়ে খাদেমনগরের উপর আক্রমণ চালাবে গুর্খা ব্যাটালিয়ন। বাঁয়ে আক্রমণ করবে আমাদের সৈন্যরা। খাদেমনগর পাকিস্তানীদের বিরাট এবং শেষ ঘাঁটি।

 ১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সন। চারধারে পাকিস্তানীরা মজবুত ব্যূহ রচনা করেছে। যতবড় ব্যুহই রচনা করুক বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সিলেট আর বেশী দূর নয়। তারা এগিয়ে যাবেই। পেছনে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। ভারতের গুর্খা ব্যাটালিয়ন রাস্তার ডানে এবং আমাদের সৈন্যরা রাস্তার বাঁয়ে এগিয়ে চলেছে খাদেমনগর দখলের চেষ্টা। কিছুদূর এগিয়েছি। সামনে ইদগা এবং উঁচু টিলা থেকে মর্টার ও মেশিনগানের গোলাগুলি আসতে লাগল। কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার শুরু হয় গোলাগুলির আওয়াজ। বেলা বাড়তে লাগল। রাস্তার ডানে এবং বাঁয়ে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আমার এক কোম্পানী ঈদগার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। একেবারে খোলা জায়গা। তবে দু-একটা টিলা ছিল। বেলা প্রায় পাঁচটা।