পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
307

ইসলামীর দালালরা ও বিহারীরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যকলাপে বাধা সৃষ্টি করত। কিন্তু আবার অনেক রাজাকার এমনকি শান্তি কমিটির অনেক সদস্য গোপনে শত্রুদের অনেক খবর আমাদেরকে দিত। লালমনিরহাট থানার বাবোবাড়ি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সদস্য আবুল কাসেমের বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাওয়ায় পাকসেনারা নির্মমভাবে আবুল কাসেমকে হত্যা করে। আবুল কাসেমের স্বাধীনতা সংগামে অবদান কম নয়।

 নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। প্রতি রাতেই তাদের উপর হামলা চালান হত। রংপুরের সিনেমা হলে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ১০ জনের মুক্তিবাহিনীর একটা পার্টিকে এ কাজের জন্য পাঠানো হয়েছিল। লালমনিরহাট, কালীগঞ্জ, ভোতমারী, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম, তিস্তাঘাট, কাউনিয়া, পীরগাছা, গঙ্গাচরা, মিঠাপুকুর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পাক অবস্থানে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এমনকি রংপুর শহরেও আমাদের কার্যকলাপ শুরু হয় যায়। এর মধ্যে আমাদের কার্যকলাপ গ্রাম ছাড়িয়ে শহর ও সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শুরু হয়। পাকসেনারা এরপর আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তারা প্রায়ই সবসময় বাঙ্কার আর ছাউনি ছেড়ে বাইরে যেত না। কোন অপারেশনে গেলে তারা রাজাকারদের সামনে এগিয়ে দিত এবং নিজেরা ডিফেন্স পজিশনে থাকত।

 ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমরা অনেক এলাকা পাকসেনাদের হাত থেকে মুক্ত করে ফেলি। পীরগাছা, মিঠাপুকুর, গঙ্গাচরা ও কাউনিয় থানা এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ২রা ডিসেম্বরে সেক্টর কমাণ্ডার বাশার আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ১টা ব্যাটালিয়ন তৈরী করে লালমনিরহাট ও তিস্তাঘাট হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশসহ আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে লালমনিরহাটের দিকে অগ্রসর হই। পাটগ্রাম সাব সেক্টরের কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান বারখাতা, হাতিবান্ধা কালিগঞ্জ হয়ে লালমনিরহাটের দিকে এগিয়ে আসেন। অন্যদিকে সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, পাটেশ্বরী, কুড়িগ্রাম হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হন। নীলফামারী মুক্ত করে আমরা তিস্তা ঘাটে একত্রিত হয়ে রংপুর শহরের দিকে অগ্রসর হই। ১৫ই ডিসেম্বর অনেক বাধাবিপত্তির পর রংপুর শহরে পৌছাতে সক্ষম হই। আমরা তাদের উপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে শহর থেকে সরে ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকায় যেতে বাধ্য করি। ১৬ই ডিসেম্বর পাকসেনারা মিত্রবাহনী ও আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

 পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা আমার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে অভ্যন্তরে চলে যায়। এসব মুক্তিযোদ্ধারা অসমসাহসী ছিল। তারা পাকসেনাদের বারবার আচমকা আক্রমণ চালিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল। আগস্টের শেয়ে প্রাক্তন এমসি-এ কে, বি, এম, আবু হেনা এদেরকে নিয়ে সিরাজগঞ্জে চলে যান। জনাব হেনা স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তার মত সাহসী এম সি এ ও মুক্তিযোদ্ধা আমি খুব কমই দেখেছি। দেশকে মুক্ত করার জন্যে তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পর্যন্ত প্রস্তুত ছিলেন। সিরাজগঞ্জের ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে আবু হেনাকে কোম্পানী কমাণ্ডার, মিঃ সাইদুর রহমানকে সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড, মিঃ আমির হোসেন, বেলায়েত হোসেন ও বজলুর রহমানকে প্লাটুন কমাণ্ডার করে আবু হেনার নেতৃত্বাধীনে সিরাজগঞ্জ এলাকায় পাঠিয়ে দেই।

 মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ ও সুশৃংখলা বজায় রাখার জন্য তাদের মধ্য থেকে কোম্পানী কমাণ্ডার, প্লাটুন কমাণ্ডার ও সেকশন কমাণ্ডার নিয়োগ করি। মুক্তিবাহিনীকে কোম্পানী, প্লাটুন ও সেকশনে ভাগ করি শত্রুদের উপর সুষ্ঠুভাবে আক্রমণ পরিচালনার জন্য। আমার কয়েকজন সাহসী শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান মুক্তিযোদ্ধার নাম নিম্নে প্রদান করছিঃ

 ১। বদরুজ্জামান, কোম্পানী কমাণ্ডার; ২। সিরাজুল ইসলাম, কোম্পানী সেকেণ্ড-ইন কমাণ্ড; ৩। মজাহার আলী, প্লাটুন কমাণ্ডার সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড, ৪। একরামুল হক, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন কমাণ্ড; ৫। নূরুল আলম