পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
332

সরকার ৩৫০ জন এফ-এফ নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন। হানাদার পাকিস্তানীদের ডিফেন্স হচ্ছে শঠিবাড়ি বন্দরের দক্ষিণ এবং পশ্চিম সাইডে। এক কোম্পানী ফোর্স নিয়ে সিমেণ্টের মজবুত বাঙ্কারে মেজর হায়াত শক্তিশালী ডিফেন্স নিয়ে দীর্ঘ ছয় মাস বসে আছে। তাদের সাথে আছে ই-পি-কাফ (ই-পি-আর-এর ধরনে সে সময় পাক ফোর্সদের গঠিত একটি বাহিনী) এর ১ কোম্পানী, রাজাকার ছিল শ'তিনেক। তার ওপর পেছনে ছিল আর্টিলারী। হেভি মেশিনগান, ছয় ইঞ্চি মর্টার, এল-এম-জি, ১টা তিন ইঞ্চি মর্টার, কিছু স্টেনগান আর বাকী সব থ্রি-নট-থ্রি।\

 সেক্টর কমাণ্ডার খাদেমুল বাশার সাহেবের নিকট থেকে ৭নং কোম্পানী কমাণ্ডার নির্দেশ পান শঠিবাড়ির হানাদারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য। প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা “হিট এণ্ড রান” পদ্ধতি অনুসরণ করে পুরা আগষ্ট মাস। সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখ পর্যন্ত তাদেরকে ব্যস্ত রাখে। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা গড়ে তোলে পাকা বাঙ্কার। শঠিবাড়ি বন্দরের পূর্ব ও উত্তর দিকে পাক হানাদারদের এক হাজার গজ দূরে এই সব বাঙ্কার তৈরী করে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল বাড়িয়ে তোলে। এবং এই সময় মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদারা যার যার পজিশন থেকে গোলাগুলি বিনিময় করতো।

 সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ। কোম্পানী কমাণ্ডার হারেসউদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদারদের ৬০০ গজ দূরত্বের মধ্যে চলে আসে। ২রা সেপ্টেম্বর রাত ৩টায় কমাণ্ডার নিজে এস-এল-আর নিয়ে হানাদার পজিশনে ফায়ার ওপেন করে দেন। শুরু হয় মরণযুদ্ধ। হারেসের ছেলেরা প্রতিজ্ঞা করে শঠিবাড়ি বন্দর দখল না করে তারা পিছু ফিরবে না।

 শঠিবাড়ি হাইস্কুলের ভেতরে নির্মিত দুর্ভেদ্য ঘাঁটি থেকে শেল বর্ষণ করে খান সেনারা। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। খান সৈন্যদের মুহুর্মুহু শেল ও রকেটের আঘাত এস পড়ছে মুক্তিবাহিনীর ওপর। ভাঙ্গছে বাঙ্কার, আহত হচ্ছে মুক্তিসেনা। ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে পিছনে। সামনে এগুচ্ছে আরেকজন মুক্তিসেনানী, করছে আঘাত শত্রুর বাঙ্কারে, পজিশনে গোলা-গুলি আর আর্তনাদে ভরে উঠলো ডিমলা থানার শঠিবাড়ি বন্দর। সমান গতিতে যুদ্ধ চলছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটছে না। সমানে সমানে যুজে যাচ্ছে একে অপরকে একদিকে কমাণ্ড করছেন হানাদার বাহিনীর দুর্ধর্ষ মেজর হায়াত, অন্যদিকে শ্যামল বাংলার এক তরুণ বীর হারেসউদ্দিন সরকার। এক বাহিনী ছুড়ছে কামানের গোলা, রকেট ও শেল। অন্য বাহিনী দুয়েকটি এল-এম-জি আর থ্রি-নট-থ্রি দিয়ে তার জবাব দিচ্ছে।

 ঘণ্টার পর ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে। ৪ তারিখ সকাল থেকে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেল। হারেস উদ্দিন সরকার কয়েকজন সাহসী সাথীকে নিয়ে পর পর কয়েকটি সম্মুখের বাঙ্কার পার হায়ে এ্যডভান্স করে গেল সম্মুখপানে। হানলো এ-এম-জি'র নিখুঁত আঘাত হানাদার বাহিনীর মেইন পজিশন শাঠিবাড়ি স্কুলের ভেতরের বাঙ্কারে। দুপুর বারোটার দিকে চাঞ্চল্য দেখা গেল হানাদারদের বাঙ্কারে ও ডিফেন্স পজিশনে। দ্বিগুণ শক্তিতে হারেসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে যেতে লাগলো সম্মুখপানে। সে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। শঠিবাড়ি বন্দর আর কয়েক মিনিটের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের করায়ত্ত হবে। প্রতিটি বাঙ্কারের মুক্তিযোদ্ধারা বৃষ্টির ঝাঁকের মত গুলি ছুড়ছে। হানাদার বাহিনী তাদের ডিফেন্স লাইন ছেড়ে পিছনে হটে যাচ্ছে বীর হারেস, বীর তার বাহিনী, বুকে থ্রি-ট- থ্রি চেপে ধরে সম্মুখপানে গড়িয়ে গড়িয়ে দখল করছে সামনের ভুমি। মরিয়া হয়ে টিপে যাচ্ছে থ্রি-নট-থ্রি ট্রিগার। জয় তারা ছিনিয়ে আনবেই। হানাদারকে পালাতে হবে শঠিবাড়ি থেকে। ট্রেও পাকিস্তানী বাহিনী তাজ্জব বনে গেল। এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার কমাণ্ডে এগিয়ে আসছে থ্রি-নট-থ্রি হাতে বাঙালী তরুণ বালক। অব্যর্থ গুলি ছুড়ছে তাদের বাঙ্কারে। ছেড়ে যেতে হচ্ছে তাদের ডিফেন্স পজিশন।

 কোম্পানী কমাণ্ডার হারেসউদ্দিন ঘোষণা কর দিল ৪ঠা সেপ্টেম্বর সূর্য ডোবার আগেই শঠিবাড়ি বন্দর মুক্ত হয়ে যাবে। তিনশ' মুক্তিযোদ্ধা দম ধরে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে হানাদারদের প্রত্যেকটা বাঙ্কারে। শঠিবাড়ি বন্দরের জয় অত্যাসন্ন। আক্রমণের মুখে আর দাঁড়াতে পারছে না হানাদাররা। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে পতন হয়ে যাবে। মুক্তিযোদ্ধারা পতাকা তুলে ধরে 'জয় বাংলা' বলে চীৎকার করছে। এমন সময় হানাদার এলো আকাশ