পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
368

 করলেন। সবশেষে বিদায় নেবার পূর্বে মাননীয় স্টোনহাউসের আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট আমি আমার স্বাক্ষর ও সেক্টর হেডকোয়ার্টার মোহর দিয়ে লিখে দিলাম- “Admitted into Bangladesh and allowed to visit liberal area. “

 ১৫ই মে থেকে নিয়মিতভাবে প্রত্যেক কোম্পানীকে সাপ্তাহিক অপারেশনাল ট্যাঙ্ক দিতে থাকলাম এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন সিচুয়েশন রিপোর্ট নিয়মিতভাবে বিডিএফ হেডকোয়ার্টারে পাঠাতে থাকলাম। সেক্টর কমাণ্ডার হিসাবে আমি প্রতিনিয়তই কোম্পানী থেকে কোম্পানী এলাকা ভ্রমণ, পরিদর্শন ও অপারেশনাল কাজকর্মগুলো সমন্বয় করতে থাকলাম।

 একটা কথা বলতে ভুলে গেছি যে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রাক্তন ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট জামালুদ্দিন চৌধুরী এমপি-এ ও ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব এবং লেফটেন্যাণ্ট ইনামুল হক (বর্তমান ক্যাপ্টেন ও প্রেসিডেণ্ট এডিসি) আমার হেডকোয়ার্টারে যোগদান করেন। ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট জামালুদ্দিন চৌধুরীকে আমার সেক্টর সদর দপ্তরে স্টাফ ক্যাপ্টেন পদে নিয়োগ করি। সমস্ত অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনার ভার ছিল তার উপর, যা তিনি অতি সুষ্ঠু সমর পরিচালকের মত সম্পন্ন করেন।

 প্রায় প্রত্যেক অপারেশন টাস্ক সম্পূর্ণ করতে গিয়ে কিছু না কিছু পাকসেনা হতাহত এবং অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করা হত। মাঝে মাঝে শত্রুসেনা বন্দীও করা হত। রাজাকার আত্মসমর্পণ, দালাল নিধন ইত্যাদি ছিল প্রায় নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয় ৭ম কোম্পানী এলাকায় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের অধীনে। সেদিন ছিল ২৭শে মে, ১৯৭১ সাল। আমাদের অবস্থান ছিল সীমান্তবর্তী একটা বাঁধের উপরে ও তার পিছনটায়। আমাদেরই এই উঁচু পজিশনের জন্য পাকিস্তানীরা কাছে ঘেঁষতে পারত না। দূর থেকেই তাদের আমরা তাড়িয়ে দিতে পারতাম। এই পজিশনটাকে ভাইটাল মনে করে পাকিস্তানীরা ২৭শে মে ভোর ৪টার দিকে ২ কোম্পানী সৈন্য দিয়ে আমাদেরকে আক্রমণ করে। তীব্র যুদ্ধের পর তাদের ঐ আক্রমণ প্রতিহত করা হয়। ২ ঘণ্টা পর আবার তারা ২ কোম্পানী সৈন্য নিয়ে আমাদের অবস্থানকে আক্রমণ করে। এবারও তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করা হয়। এভাবে পর পর ৬ বার তারা ২ কোম্পানী এবং ১ ব্যাটালিয়ান দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে আমাদের উপর আক্রমণ চালায় কিন্তু প্রত্যেকবারেই ক্ষয়ক্ষতির পর তারা পিছপা হতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধ ১৪ ঘণ্টাকাল স্থায়ী হয় এবং তাদের আনুমানিক ৩০০ সৈন্য হতাহত হয়। এর মধ্যে তাদের ব্যাটালিয়ান কমাণ্ডার আহত হয় এবং ব্যাটালিয়নের ২য় কমাণ্ডার ও ১ জন ক্যাপ্টেন মারা যায়। উৎসাহভরে এই ক্যাপ্টেনের লাশ নিজ এলাকায় দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ঐ ক্যাপ্টেনের লাশ আনতে সক্ষম হয়। ঐ চেষ্টায় প্রথমত ১ জন জওয়ান মারা যায়। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ঐ ক্যাপ্টেনের লাশ আনতে সক্ষম হয়। এছাড়া আরও ৫ টি পাকসেনার লাশ উদ্ধার করে অপর বাংলায় জনসাধারণকে দেখানোর জন্য পাঠান হয়। ভারতীয় জনসাধারণ বাঙ্গালীদের বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে। এভাবে চলতে থাকে আমাদের দৈনন্দিন মুক্তিযুদ্ধ এবং শত্রুহনন অভিযান। হিসাব করে দেখা গেছে এই সেক্টরে গড়ে প্রতিমাসে ৭০০ শত্রুসেনা নিধন হয়েছে।

 প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, ১৯৭১ সনের জুন অথবা জুলাই মাসে বাংলাদেশের সেনাপতি ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের কধ্যে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, বাংলাদেশের সেক্টরগুলিতে কিছুসংখ্যক ভারী ও হালকা হাতিয়ার বন্ধুরাষ্ট্র ভারত আমাদেরকে দেবে। সেই অনুযায়ী আমি বারবার ভারতীয় কমাণ্ডারদের কাছ থেকে চেয়েও ঐ হাতিয়ার গুলি পাইনি। সময়মত ঐ অস্ত্রশস্ত্র না পাওয়ায় আমাদের যুদ্ধ চালাতে যথেষ্ট অসুবিধা হয়।

 ১৯৭১ সনের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার মুজিবনগরে সেক্টর কমাণ্ডারদের কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সের উদ্বোধনী দিনে সাধারণভাবে বাংলাদেশ বাহিনীর সেনাপতি কর্নেল ওসমানীরই ভাষণ দেবার কথা, কিন্তু উদ্বোধনী ভাষণ শুরু করলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাননীয় তাজউদ্দীন আহমদ। ব্যবস্থানুযায়ী তা যদিওবা হ'ল তবুও কর্নেল ওসমানীর উপস্থিতি সেখানে ছিল অপরিহার্য। কিন্তু তিনি নেই দেখেই ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হল। যাই হোক লম্বা-চওড়া উদ্বোধনী বক্তৃতার পর প্রধানমন্ত্রী