পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
385

ভেতরটা তার বড্ড নরম, বড্ড কোমল। পরবর্তি পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে যে সফলতা এসেছে সেটা সম্ভব হয়েছিল। তার সুষ্ঠ নির্দেশনা ও ব্যক্তিত্বের জন্য। তাকে ভুলব না।

সুন্দরবনে প্রেতাত্মা

 কোন কোন লোকের কতকগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন আমি দেখেছি যখনই তারা তাদের ইপ্সিত কোন কিছু সমাধা করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই বশ্যতা স্বীকার বা মাথা নোয়াবার পরিবর্তে ওই কাজটাকে সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য দ্বিগুন উৎসাহে বার বার চেষ্টা করেছে। নিরাশ হয়নি বা আশা ছেড়ে দেয়নি। এইসব লোকদের আমি ঈর্ষা করতাম, তাদের পদাংক অনুসরণ করার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হতাম। একবার দৃঢ় আত্মপ্রত্যায়ে বলীয়ান হলে পরাজয়ের গ্লানিটুকু অকিঞ্চিতকর মনে হয়। বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে যখন আমি ভারতে আসি, তখন মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে এ রকম একটা অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলাম। শেষবারের মতো আমি ৭২নং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অধিনায়ক মিঃ মুখার্জীর বাসভবনে থামলাম। অস্ত্রশস্ত্র যোগাতে তিনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। শৈভোজের পর তিনি আমাদের গাড়ীতে করে কোলকাতায় নিয়ে গিয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিরাপত্তা বাহিনীর ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মিং মজুমদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁকে জানালেন যে, অধিনায়ক হিসেবে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য আমি অনেক কাজ করতে পারবো। আমার কি কি অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন মিঃ মজুমদারকে জানালাম। তিনি বেশ ধৈর্যের সাথে কথাগুলো শুনে আমাকে আশ্বাস দিয়ে ভদ্রভাবে বললেন যে, তার সামর্থ্যমত প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র যুগিয়ে দিতে চেষ্টার ত্রুটি করবেন না। মিঃ মজুমদারের ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। বেশী আশ্চর্য হলাম তার সুন্দর ভদ্রতাবোধ দেখে এবং আশ্বাস বাণী শুনে।

 ওই দিনই সন্ধ্যায় কোলকাতার আসাম হাউজে নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিঃ রুস্তমজীর সাথে সাক্ষাৎ করতে হলো। মিঃ মুখার্জীকে নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করলাম। আমার প্রতি যে আন্তরিকতা ও ভদ্রতা দেখিয়ে তিনি আমাকে সাদরে গ্রহন করেছিলেন তাতে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। বেশ আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী সিনিয়র অফিসার। তার সাথে কথাবার্তায় আমার দৃঢ় বিশ্বাস হলো যে, বেশ অল্পদিনের ভেতরেই আমরা অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে যাব। অস্ত্র যোগাড় করাটাই আমার আসল উদ্দেশ্য। আমার চলাফেরার সময় মিঃ মুখার্জী ও তার অফিসের কর্মচারীরা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। তাদের ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক ও বন্ধুসুলভ।

 ১৯৭১ সালের ২৪শে এপ্রিল মিঃ মুখার্জির গাড়ীতে করে আমাকে মেজর উসমানের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি মুক্তিসংগ্রামের আর একজন অধিনায়ক। পাক দখলদার বাহিনীর সাথে তাঁর ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে পর পর কয়েকটা যুদ্ধ করে উত্তর বাংলার পট্রাপোলে তিনি ঘাঁটি গেড়েছেন। মেজর উসমান পাক আমলে ইপিআর-এ চাকরি করতেন। তিনি অনেক হালকা অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করে রেখেছিলেন তার ঘাঁটিতে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র জমা দেখে আমার লোভ হলো। কারণ, পৃথিবীর যে কোন জিনিসের চাইতে এই প্রয়োজনের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিকের কাছে একটি মাত্র রাইফেল সবচেয়ে বেশী মূল্যবান। কেননা, অস্ত্র ছাড়া একজন সৈনিকের গর্ব ভূলুণ্ঠিত হতে বাধ্য। যাহোক অনেক কষ্টে অনেক বলা-কওয়ার পর মেজর উসমানকে বুঝতে সক্ষম হলাম যে আমিও তাঁর মত দেশের জন্য যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেজর উসমান রাজী হলেন। অন্ধকারের ভিতর আশার আলো দেখতে পেলাম। সমস্ত কৃতিত্বই অধিনায়ক মিঃ মুখার্জীর। তিনি নিজে মেজর উসমানকে ব্যাপারটা গুরুত্ব বুঝিয়ে রাজী করিয়েছিলেন। সুতরাং এক ট্রাক বোঝাই হালকা অস্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নিয়ে আমি হাসনাবাদ ফিরে এলাম। এখানে এগুলো লঞ্চে বোঝাই করার বন্দোবস্ত করতে হবে। মেজর উসমানের সাথে আলাপ-আলোচনার সময় আমার সহকারী ক্যাপ্টেন হুদা বেশ ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেল। তার উপরে প্রশাসনিক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমি মিঃ মুখার্জীর সাথে ফোর্ট উইলিয়াম ও পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের সদর দপ্তরে রওয়ানা হয়ে গেলাম।