পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
392

কষ্টে নদী পার হলাম। কিন্তু বড় বিপদে পড়লাম। কেননা, কোনো টেম্পো গাড়ীওয়ালা এই দুর্যোগ ঝড়ের মধ্যে গাড়ী ছারতে সাহস পেল না। এই দুঃসাহসিক কাজে ওদের রাজী করাবার জন্য বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনগুণ ভাড়ায় পৌছে দিতে ওরা সম্মত হলো। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমরা বরুনহাট নামক একটা জায়গায় নদীর পাড়ে পৌঁছলাম। খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার সাথে দুটো প্রধান স্থলপথে বসন্তপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা- একটা পারুলিয়া হতে কালিগঞ্জ ও নাজিমগঞ্জ হয়ে, অন্যটা সাতক্ষীরা- শ্যামনগর রোড। পারুলিয়া থেকে যে রাস্তাটা গিয়েছে সেটা বেশ প্রশস্ত। সিএগুবি'র রাস্তা। ভারী সামরিক যানবাহন এর উপর দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু পরেরটা বিশেষ সুবিধাজনক নয়। তবুও পাকিস্তানী শত্রুবাহিনী প্রায়ই এই রাস্তায় চলাফেরা করতো। তাই সৈন্য চলাচল ও আক্রমণ পরিচালনার জন্য সামরিক দিক দিয়ে বসন্তপুর ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ। বসন্তপুর অধিকার করে উপরোক্ত রাস্তা দুটোর উপর প্রভাব বিস্তার করার অর্থ একশ' বর্গমাইল মুক্ত এলাকা হাতের মধ্যে আসা এবং এই সংকটময় দিগুলোতে এটা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার।

 ইছামতী নদীর চাইতে বরুনহাটের এই নদীটি পাশে ছোট। কিন্তু দেখতে ভয়ংকর দৈত্যের মতো। এই অবস্থায় খেয়া পার হওয়া সাংঘাতিক বিপজ্জনক। অযথা সময় নষ্ট না করে সুযোগসন্ধানী এক নৌকার মাঝিকে বেশী টাকা দিয়ে নদী পার হলাম। কোন যানবাহন ছিল না। দীর্ঘ পাঁচ মাইল রাস্তা হেঁটে হিংগলগঞ্জে ক্যাপ্টেন হুদার আস্তানায় পৌঁছতে হবে। ভয়ানক শীত। তার উপরে বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজে গিয়েছিল। হাঁটু পরিমাণ কাদা ভেঙ্গে ক্যাপ্টেন হুদার ঘাঁটিতে পৌঁছালাম। সামান্য একটু উঁচু জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা আস্তানা গেড়েছিল। তাঁবু ভেদ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। ক্যাপ্টেন হুদাকে বড় বিষন্ন মনে হলো। উঁচু জায়গাটার চারদিকে বৃষ্টির পানি জমে সমুদ্রের মত মনে হলো। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে আমাকে আসতে দেখে হুদা যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল। মুখে তার দৃঢ়প্রত্যয়ের হাসি। কাছে গিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। ‘জয় বাংলা’ বলতেই সবাই বৃষ্টি মধ্যে লাফিয়ে পড়ে ‘জয় বাংলা' ও 'শেখ মুজিব জিন্দাবাদ' ধ্বনি তুলে আমাদের স্বাগত জানালো। এই দৃশ্য অভূতপূর্ব। ইত প্রাণচাঞ্চল্য আমি আর আগে কখনও দেখিনি। ওদের সেই প্রাণচাঞ্চল্যে খুঁজে পেলাম আগামী দিনের বিজয়োৎসবের গোপন সংকেত। ওদের মনেভাবের উত্তপ্ততা লক্ষ্য করে আমি চিৎকার করে প্রশ্ন করলামঃ 'আজ রাতেই তোমরা কি সবাই যুদ্ধ করতে রাজী আছো?' ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ৩৫শত লোকের মত চিৎকার দিয়ে উত্তর দিলঃ 'হ্যা স্যার, আমরা সবাই প্রস্তুত।” ওদের উচু মানসিক শক্তির পরিচয় পেয়ে আমি খুব ভরসা পেলাম। আগ্রহী কণ্ঠ বললাম, ওকে। এই বলে ওদের বিদায় দিয়ে হুদার তাঁবুতে ফিরে গেলাম এবং আমরা ম্যাপের উপর ঝুঁকে পড়ে কোথায় আক্রমণ চালাতে হবে সবাইকে বুঝিয়ে দিলাম। এ ব্যাপেরে সোবহান নামে একজন হাবিলদার অনেক সাহায্য করেছিল। পাকিস্তানী আক্রমণের আগে সোবহান বসন্তপুর গোয়েন্দার কাজ করেছে। কাজেই সেখানকার সব খবরই তার জানা ছিল। ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালনার ব্যাপেরে সে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছিল।

 রাত একটায় শত্রুপক্ষের বাঙ্কারে ঝটিকা আক্রমণের পরিকল্পনা। উদ্দেশ্যে, ওদের বাঙ্কারে নিক্ষেপ করে কাবু করা এবং পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসা। পরিকল্পনাটার শুনতে মধুর ও উত্তেজনাকর লাগলেও- এই ঝড়ের রাতে এই দুঃসাহসিক কাজটা সমাধান করা ছেলেখেলা নয় তবু তারা, বা প্রথম অভিযানের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হুদা, মোটেই দমলো না। খুব জেরে ঝড় বইছিল। একবার ভালাম ঝড়ের রাতে এই বিক্ষুব্দ নদীটা পার হওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু মন থেকে এই নৈরাশ্যকে দূরীভূত করলাম। করলাম কেননা আমাদের বিজয় সম্বন্ধে আমি খুবই আশাবাদী ছিলাম। জানতাম সবাইকে বিস্মিত করে অভিযান সফল হবেই। ব্যাস্তসমস্ত হয়ে সবাই সামান্য খাবার খেয়ে নিলাম। শৌখিন পাচকেরা এসব পাক করেছিল। তারাও অভিযানে শরিক হলো। যখন আমি হুদার কাছে আমার উদ্দেশ্যের কারণ ব্যাখ্যা করছিলাম, তখন হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা ধারণা এলো যে, একই সঙ্গে টাউন শ্রীপুরে পাক হানাদারদের অপর একটি ঘাঁটি আক্রমন করব। ভারতের সীমান্তবর্তী শহর ‘টাকি'র অপর দিকেই টাউন শ্রীপুর। সেখানে শাজাহান নামে একটা স্কুল শিক্ষকের অধীনে