পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
416

করা হতো। মিঃ ফজলুল হক ও সুলতানউদ্দীন আহমেদ যথাক্রমে সদর দপ্তর ও গেরিলা ক্যাম্পের সামরিক দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল। তাদের শেষ নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি ফিরে গেলাম।

 চার্লি সেক্টর থেকে সর্বশেষ যে নির্দেশ পেলাম, তা হলো- অস্ত্রপাতি ছাড়া মুক্তিযোদ্ধদের বিদায় দিতে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বিভিন্ন যুবকেন্দ্রের ম্যানেজাররা এম সি এ’রা স্বাধীনতার উল্লাসে আত্মহারা হয়ে ছেলেদের ফেলে রেখে যে যার মত আগেই চলে যায়। আর ছেলেরা পড়ে মহাসংকটে। বাংলাদেশে ফিরে যাবার মত কোন সম্বলই ছিল না তাদের। তারা আমার হেডকোয়ার্টরের চারিদিকে এসে ভীড় করলো এবং অনুরোধ জানালো যে তাদের জন্য যেন কোন বন্দোবস্ত করে দেই। আমার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে ছেলেদের যাবার বন্দোবস্ত করার জন্য সুলতান ও হককে বলে দিলাম।

 দিনটা ডিসেম্বরের ৯ তারিখ। সবকিছুই এলোমেলো। কারুর দিকে কারুর দৃষ্টি নেই। কাজকর্ম ফেলে রেখে সবই বাংলাদেশের ভেতরে চলে যেতে চায়। আমি তাদের মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু পিছনের কাজকর্ম গুছিয়ে দেয়ার জন্য কাউকে অন্ততঃ এখানে থাকতে হবে। পরিকল্পনা মোতাবেক বেগকে তার দলবলসহ গণ-পরিষদ সদস্য মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর সাথে বরিশালে পাঠিয়ে দিলাম।

 টাকি ও হাসনাবাদের দিকে চেয়ে মনটা কেঁদে উঠলো। মনে হলো, ওরা আজ বড্ড শূন্য, বড্ড নিঃসংগ। দীর্ঘ ন'মাস যাবৎ অসংখ্য মুক্তিযেদ্ধা ও শরণার্থীর ভীড়ে কর্মচঞ্চল হাসনাবাদ ও টাকি আজ নীরব। যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আমি ভয়ানক অন্তজ্বালা অনুভব করলাম। শেষবারের মত ইছামতী ও আমার হেডকোয়ার্টারের দিকে অশ্রুসজল চোখ দুটো বুলিয়ে মোস্তফাকে আমার জীপে উঠতে বললাম। অন্যমনস্কভাবে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম, হক ও অন্যান্য সাথীদের দিকে। পরে খুলনায় এসে আমার সাথে যোগ দেয়ার জন্য ওদের নির্দেশ দিলাম এবং আমাদের অগ্রবর্তী বাহিনীর সাথে যোগ দেয়ার জন্য আমি এগিয়ে চললাম। পিছনে পড়ে রইল স্মৃতিবিজড়িত হামসাবাদ, টাকি-চেনা-অচেনা মুখ ও হাসিকান্নার অনেক গল্প।

 বিজয়ের আনন্দে আমার গাড়ী ঢাকাগুলো অসম্ভব দ্রুতবেগে ঘুরতে লাগলো। আমি দৌলতপুর থেকে ১০ মাইল দূরে একটি স্কুলের কাছে আমার লোকজনদের সংগে মিলিত হলাম। এই জায়গাটার নাম শাহপুর। এখান থেকে একটি রাস্তা বের হয়ে যশোরর- খুলনার বড় রাস্তার সাথে ফুলতলার কাছে এসে মিশেছে।

 ডিসেম্বরের ৯ তারিখের রাত। স্কুল থেকে অগবর্তী এলাকায় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী মাত্র এক মাইল দূরে। শত্রুপক্ষের অবস্থানের হাজার গজের মধ্যে মিলে এক কোম্পানী সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। ৯ তারিখ রাত্রেই আমি ওদের কাছে যেতে চাইলাম। কিন্তু ওদের কাছে, পৌছানো দুঃসাধ্য ছিল। কেননা, ওরা তখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সুতরাং স্থির করলাম, ১০ তারিখে ভোরে ওদের সাথে মিলিত হবো। রাতটা ভয়ানক রকমের অশান্ত। সারারাত ধরে দ'পক্ষের কামানগুলো অবিশ্রান্ত গর্জন করছিল। স্কুলের ছাদে উঠে আমি, মোস্তফা, ডাঃ শাজাহান ও হুদা দেখতে পেলাম সারা আকাশটা লালে লাল। কামানের গর্জনে স্কুলের ছাদটা থরথর করে কাঁপছে। খুবই উত্তেজক সন্দেহ নেই। কিন্তু বড় করুণ, বড় নির্মম। কেননা, শত্রু মিত্র অনেক মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে হিংস্র কামানের গোলায়। সমস্ত রাত শুধু কামানের গর্জন আর গর্জন।

 ১০ই ডিসেম্বর থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টা অতিবাহিত হলো অহেতুক উদ্দীপনা, উত্তেজনা ও এক রকম বিশ্রামের মধ্য দিয়ে। মুক্তিসংগ্রামের শেষ পর্ব। দুঃখ ও আনন্দে আবহাওয়া ভারাক্রান্ত। স্থানীয় লোকজন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা। নানাভাবে আতিথ্য দেখিয়ে জনগণ আমাদের মুগ্ধ করলো। যেন আমরা সবাই একই সংসারের লোক, একই সুখ দুঃখের ভাগী। রাস্তার পার্শ্বে সেই স্কুলটায় যে সপ্তাহটা কাটিয়েছিলাম, তার পূর্ণাংগ চিত্র তুলে ধরার জন্য রণাংগনের ডাইরীর কিয়দংশ তুলে ধরছিঃ