পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
431

পটুয়াখালী ও গলাচিপা থানা নিয়ে জোন গঠন করা হয় তার দেয়া হয়েছিল আমার উপর। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পরে আমি আমার দল নিয়ে আমার নিদের্শিত জায়গায় চলে আসি। আমার সাথে যারা ছিল তাদের সকলের নাম আমার মনে নেই। তবে যাদের নাম মনে আছে তাদের নাম এখানে উল্লেখ করছিঃ মোঃ নুরুল হুদা (কমাণ্ডার), হাবিবুর রহমান (শওকত) (সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড), খলীফা, মস্তফা, রবীন, ইউসুফ, সুলতান, হাবিব, শাজাহান, কুণ্ড, গোমেস, ভূদেব, মান্নান, শরীফ, আবুল, জাহাঙ্গীর, ফোরকান, সুনীল, কাওসার; মন্মথন, লতিফ, আলম এবং আরো অনেকে। মস্তফা এবং কাওসার বুকাবুনিয়া থেকে আমাদের পথপ্রদর্শন করছিল।

 ভারত থেকে আবদুল বারেক এম-সি-এ (পটুয়াখালী) আমাদের মুক্তিবাহিনীর হিতাকাঙ্ক্ষী অনেকের নাম দিয়েছিলেন। সেই অনুসারে একদিন পানপট্টির মিঃ রবদের বাড়ি এসে উঠলাম আমি এবং মস্তফা। রব সাহেব বিপুল উৎসাহ আমাদের সাথে সহযোগিতা করলেন। পানপট্টির একটি সাইকেনান শেলটারে আমরা শিবির স্থাপন করলাম। ওখানে বসে পাক বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালাবার পরিকল্পনা করতে থাকলাম। পটুয়াখালী জেলার পাক জান্তা প্রধান তখন মেজর ইয়ামীন। আমাদের অবস্থান তার কানে গেল। আমরা গলাচিলা থানা আক্রমণ করার সমস্ত পরিকল্পনা এবং মানচিত্র ঠিক করে ফেলেছি। ৪০ জনের একটি দল নিয়ে আমি গলাচিপা থানা আক্রমণে রওনা হলাম। কিন্তু বাস্তব এবং প্রতিকূল অবস্থান পরিপ্রেক্ষিতে সে রাতে গলাচিপা থানা আক্রমণ করা হল না। এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা আমদের অপারেশনগুলো বেশীর ভাগই রাতের দিকে করতাম।

 পানপট্টির যুদ্ধঃ তাঁবুতে ফিরে এসেছি রাত তিনটায় ৫/৬ জন সেনট্রি রেখে, বাকী সকালে ঘুমিয়ে নিচ্ছি। ঐ দিন রাত ৪টায় (১৮-১১-৭১) গলাচিপা বন্দরের ৫ বৎসরের বাবলুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার বাসার সম্মুখ থেকে অনেকগুলো বুটের শব্দ তার কানে এলো। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বাবলু। সাবধানে জানালাটা খুলে দেখল পাকদস্যুর এক বাহিনী বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একটু পরেই কয়েকটা রাজাকারের চাপা আলোচনা থেকে সে বুঝতে পারল পাকদস্যুরা আমাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে পানপট্টি যাচ্ছে। বাবলু ছিল গলাচিপা বন্দরে আমাদের একজন গুপ্তচর। আর তো বাবলুর বসে থাকা চলে না। পিছনের দরজা দিয়ে বাবলু দৌড় আরম্ভ করল। এক নাগাড়ে ছয় মাইল দৌড়ে আমাদের শিবিরের উত্তর পাশের নদীটির পারে ছুটে চলে এলো। দুর্ভাগ্য! ঘাটে খেয়া নেই। কিন্তু তাতে কি। বাবলু ঝাঁপিয়ে পড়ল নভেম্বরের ঠাণ্ডা নদীতে। সাঁতরিয়ে চলে এলো এপার। আর একটা দৌড়। তারপরই আমাদের শিবির। আমাকে যখন বাবলু খবরটা দিল তখন সকাল ৬-৩০মিঃ। অন্য সকলে ঘুমে। শওকত ও উঠে গেল। ফল-ইন এর বাঁশি বাজিয়ে দিল শওকত। সবাই ছুটে এল ফল-ইন-এ। সংক্ষেপে বুঝানো হল ব্যাপারটা। শওকতকে পাঠালাম সাইক্লোন শেলটারের ছাদে। সেটা ছিল আমাদের ও-পি। বাইনোকুলার লাগিয়ে শওকত পাকবাহিনীর গতিবিধি সব বলে দিতে লাগল। আমি সে অনুসারে ঢেলে সাজালাম আমার দলের সবাইকে। আগে থেকেই আমাদের বাঙ্কার করা ছিল। আবুল ছিল প্রথম এল-এম-জি ম্যান। ভূদেব, সুনীল ও শরীফ ছিল ওর গার্ড এবং সহকারী। সাইক্লোন শেলটারটা ছিল দোতলা দালান। দক্ষিণ দিক থেকে একটা কাঁচা রাস্তা শেলটারের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে সোজা উত্তর দিকে গলাচিপার দিকে চলে গেছে। এই রাস্তা ধরে কিছুদূর আসলে পানপট্টির সেই ছোট নদীটা সমনে পড়বে। নদী পার হয়ে রাস্তা ধরে চলে গেলে একেবারে গলাচিপা পৌঁছা যায়। শেল্টারটার সামনে একটা টিনের স্কুল, তারপর একটা খালের কূলে কূলে কয়েকটা বাড়ি এবং ঠিক পশ্চিম পার্শ্বের বাড়িগুলো লতাপাতায় ঘেরা-যা আমাদেরকে আড়াল করে রেখেছিল। উত্তর দিকের সেই রাস্তাটার দু'পাশে একটু দূরে দু'একটা বাড়ি। পূর্ব দিকটার অনেকখানি জুড়ে ধানের মাঠ। দক্ষিণ- পশ্চিম কোণে কাছাকাছি কোন বাড়ি নেই।

 ও-পি থেকে শওকতের অবজারভেশন অনুযায়ী পশ্চিম দিকের শক্তি বাড়িয়ে দিলাম। রবিন, কুণ্ড, মস্তফা, কাওসার, গোমেস ওদেরকে রাখলাম পশ্চিম দিকের একটা বাড়ির পশ্চিম পাশে ৫০ গজ ব্যবধানে কভার করে। শওকতের তথ্য অনুযায়ী পাকসেনারা পশ্চিম দিক দিয়ে আমাদের সেণ্টারের দিকে মার্চ করতে পারে। রবিনদের