পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
445

নিলেন। তিনি প্রথমে টাকীতে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে পরে হিঙ্গলগঞ্জে আমার নেতৃত্বাধীন প্রথম বেইস ক্যাম্প স্থাপন করেন। পাকসেনাদের শক্ত ঘাঁটি ছিলো শংকরা শ্রীপুর, দেবহাটা, খানজী, উকসা এবং কৈখালী। আমি বসন্তপুর পাক ঘাঁটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই। একই সময়ে টাকী বেইস থেকে শ্রীপুর পাক ঘাঁটি আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হাবিলদার সোবহান ইছামতী পেরিয়ে 'রেকী' করে সকল তথ্য সংগ্রহ করলেন।

 ১২/১৩ ই জুন রাতে আমি মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন নিয়ে পাক ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হই। অপরদিকে ইছামতী পেরিয়ে হাবিলদার সোবহান এবং শাজাহানের নেতৃত্বে একটি করে প্লাটুন শ্রীপুর পাক ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের এই দুটো দলই রাত ১২ টার পর অকস্মাৎ পাক ঘাঁটি আক্রমণ করে বসে। পাকসেনারা এই আক্রমণের জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তারা ভাবতেও পারেনি, এই দুর্যোগের রাতে প্রমত্তা ইছামতী নদী পেরিয়ে আমরা তাদেরকে আক্রমণ করতে পারি। আমার তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানীরা চরমভাবে মার খায়। সংঘর্ষে ২০ জন পাকসেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। আমরা ৫০টি রাইফেল, দুটি এল-এ-জি এবং বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করি। অপরদিকে জনাব শাজাহানের নেতৃত্বে শ্রীপুরেও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ সফল হয়। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা জানা না গেলেও মুক্তিবাহিনী ৩৫ টি রাইফেল এবং বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করে। দু'টি অপারেশনের কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আমরা ভোর বেলা মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসি।

 জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি মুক্তিবাহিনীর ১৬০জন লোক নিয়ে পাক ঘাঁটি খাঞ্জি বি-ও-পি, আক্রমণ করি। রাত ১০টায় আমি আমার বাহিনী নিয়ে লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হই। আমার বাহিনীকে তিনটি কলামে বিভক্ত করি। ডান দিকে এটি কলাম নিয়ে আমি নিজে রইলাম। বামদিকের কলামটিতে লেঃ বেগ এবং হাবিলদার সোবহান রইলেন। অপর কলামটি 'কাটআফ' পার্টি হিসেবে থাকলো। বি-ও-পিতে পাকসেনাদের শক্তি ছিলো দুই প্লাটুন। আমাদের তিনটি কলামই যথাযথ স্থানে পৌঁছে গেলো। প্রথমে নায়েব সুবেদার গুফর ৩" মর্টারের সাহায্যে পাকিস্তানী অবস্থানের উপর গোলা নিক্ষেপ শুরু করেন। উভয় পক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষ ৩০মিনিট স্থায়ী হয়। আমাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনারা পালিয়ে সাতক্ষীরা এবং দেবহাটার মধ্যস্থলে পারুলিয়া নামক স্থানে আশ্রয় নেয়। আহত অবস্থায় ৪ জন পাকসেনা বন্দী হয়। নিহতের সংখ্যা সঠিক জানা যায়নি। আমরা পাকসেনাদের কাছ থেকে ২" মর্টার, এস-এম-জি, ৭৬২ চায়নিজ রাইফেল এবং বেশকিছু গোলাবারুদ ও রেশন-সামগ্রী উদ্ধার করি। এই বিজয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মনোবল বহু গুণে বৃদ্ধি পায়।

 আমি হিঙ্গলগঞ্জে ঘাঁটি স্থাপনের কিছুদিনের মধ্যেই উকসা পর্যন্ত আমার ঘাঁটি বিস্তৃত করি। আগস্ট মাসের শেষের দিকে পাকসেনারা উকসা ঘাঁটি আক্রমণ করে। আমরাও প্রস্তুত ছিলাম। ফলে শেষ পর্যন্ত পাকসেনারা দারুণ ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই অপারেশন সম্পর্কে বাংলার মুক্ত এলাকা থেকে প্রকাশিত 'বিপ্লবী বাংলাদেশ” পত্রিকায় উকসা-গোবিন্দপুরে নয় ঘণ্টা যুদ্ধ-গোবিন্দপুর মুক্ত' শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।

 ২০ শে আগস্ট তারিখে আমি ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শ্যামনগরে আক্রমনের জন্যে অগ্রসর হই। লেঃ বেগ, সুবেদার ইলিয়াস, নায়েব সুবেদার গফুর, হাবিলদার সোবহান, হাবিলদার আবদুল হক প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাগণও আমার সাথে ছিলেন। উকসা হেডকোয়ার্টার থেকে রওয়ানা হয়ে রাত দুটায় আমরা শ্যামনগর শত্রব্যূহের কাছাকাছি পৌঁছে যাই। শ্যামনগর ওয়াপদা কলোনীতে অবস্থানরত পাকসেনাদের একটি প্লাটুন ছিলো। পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা অত্যন্ত সুদৃঢ়। আমি আমার বাহিনীকে তিনটি কলামে ভাগ করি এবং একটি কলামে আমি নিজে থাকি। সড়কের অপর পাশে একটি কলামের সঙ্গে রইলেন লেঃ বেগ। নায়েব সুবেদার আবদুল গফুর ও হাবিলদার সোবহান রইলেন অপর কলামে। আমাদের অস্ত্র ছিলো ৮টি এল-এম-জি এস, এম-জি ১২টি, ২" মর্টার ৩টি এবং অবশিষ্ট এস-এল-আর ও রাইফেল।