পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
452

 পরের দিন ভোরে আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণ ঘটে এবং তা ত্বরিতগতিতে প্রতিহত করা হয়। শীঘ্রই সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় এবং তারপর তৃতীয় আক্রমণ ঘটে- সেগুলোও সাহসের সংগে মোকাবেলা করা হয়। নিধন এলাকা শত্রুসৈন্যের মৃতদেহ ভরে ওঠে। যে কজন শত্রুসৈন্য পরিখা পর্যন্ত এগুতে পেরেছিলো তাদের বয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। আমাদের অবস্থানের দুপ্রান্তে স্থাপিত মেশিনগান দুটি সেদিন আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। মেশিনগান দুটি আড়াআড়ি গুলিবর্ষণে বেশির ভাগ শত্রুসৈন্য মারা পড়েছিল তৃতীয় আক্রমণে প্রতিহত করার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরিখা থেকে বেরিয়ে আসে এবং শত্রুদের উপর মরণ আঘাত হানার জন্য এগিয়ে যায়। খুব অল্পসংখ্যক শত্রুসৈন্য অপেক্ষমাণ গানবোট পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

 কোদালকাঠী আমাদের হস্তগত হলো। গ্রামবাসীদের মধ্যে দারুণ উল্লাসের সৃষ্টি হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও দক্ষতার উপর তাদের আস্থা বহুলাংশে বেড়ে যায়। যদিও তাদের সামর্থ্য ছিল সামান্য, তবুও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তারা রান্না করা খাবার এবং মিষ্টান্ন নিয়ে আসেন।

 সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি মেজর জিয়া তার ব্রিগেড নিয়ে সিলেটের পথে ১১ নং সেক্টর ত্যাগ করেন। সেদিন আমরা সবাই বিষন্ন বোধ করছিলাম। সে সময় আমরা জামালপুর এবং টাংগাইল হয়ে ঢাকার পথে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। শুধু যে আমাদের রণনীতি পাল্টাতে হলো তা নয়, রৌমারীর বিরাট মুক্তাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব আমাকে বিচলিত করে তুললো। আমার সেক্টরে কোন নিয়মিত বাহিনী রইলনা। আমাকে রৌমারীতে ১৫ দিনের শিক্ষাপ্রাপ্ত ছেলেদের উপর নির্ভর করতে হলো। এদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২৫ জন অস্ত্রে সজ্জিত ছিলো। রৌমারীর প্রতিরক্ষার কাজে ভারতীয় বাহিনী পাঠাবার প্রস্তাব করেছিলেন ভারতীয় কমাণ্ডার। তার সে প্রস্তাব আমি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করি। বাংলার মাটি রক্ষা করবে বাংলার বীর ছেলেরাই- রৌমারীর প্রতিরক্ষাব্যূহ আবার ঢেলে সাজাতে হবে। নেতৃত্বের পুরো ভার পড়ল সুবেদার আফতাবের উপর। চওড়া কাঁধ আর লম্বা কোঁকড়ানো চুলের অধিকারী এই নির্ভীক জে-সি-ও সব সময়ই বীরত্ব এবং দৃঢ়তার প্রতীক ছিলো। আমি যখন পুরো পারিস্থিতি তাকে বুঝিয়ে বললাম সে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করলো এবং বললো, স্যার, পাকিস্তানীরা শুধুমাত্র সুবেদার আফতাবের মৃতদেহের উপর দিয়েই রৌমারীতে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু জেনে রাখবেন সুবেদার আফতাব মরবে না। এই বিপ্লবী নেতার মনোবল যে কত উপরে ছিল তা এই উক্তি থেকে বোঝা যায়। তখন থেকেই পরবর্তীকালের বিভিন্ন সময়ে দক্ষ সৈনিক, অস্ত্র এবং গোলাবারুদের অভাব পূরণের জন্য আমাকে যুদ্ধে কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানীরা চিলমারী বন্দর থেকে গানবোটের সাহায্যে রৌমারীর মুক্ত অঞ্চলে প্রায়ই থাবা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু শত্রুরা কোন সময়ই সদাজাগ্রত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হয়নি। রৌমারীর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রে সজ্জিত করাটা আমাদের আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো এবং আমি সব সময় চাইতাম তারা শত্রুঅস্ত্রে সজ্জিত হোক এবং অস্ত্র দখলের জন্য আমার চিলমারী বন্দরকে বেছে নিলাম।

 চিলমারী আক্রমণের পেছনে আরো কারণ ছিল নেতা আবুল কাশেম এবং তার সহযোগীদের নেতৃত্বে সেখানে বাংলাদেশ বিরোধী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছিলো। চিলমারীতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর উপর আঘাত হানাটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ালো, তা যতই বিপদজ্জনক হোক না কেন। এবাবেই চিলমারী আক্রমণের পরিকল্পনা রূপ পেলো।

 ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীরে অবস্থিত চিলমারী একটি নদীবন্দর। চিলমারীর কয়েক মাইল দক্ষিণে তিস্তা নদী ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে। নদীপথ ছাড়াও চিলমারী রেল ও সড়ক দ্বারা যুক্ত। চিলমারিতে পাকবাহিনীর যাতাযাতের জন্য রেল এবং নদীপথ উন্মুক্ত ছিল। আমার অক্লান্ত গোয়েন্দা অফিসার ওয়ারেণ্ট অফিসার শফিউল্লা শত্রু সম্পর্কীয় খবরাখবর সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি শত্রুসৈন্যের সঠিক অবস্থানসহ চিলমারীর বিস্তারিত এবং হুবহু মাটির নকশা তৈরী করে ফেললেন। চিলমারীতে তখন পাকবাহিনীর