পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
461

গঠন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে ব্রিগেড গঠন করেন, যা পরে জেড ফোর্স নামে পরিচিত হয়। ঐ সময়ে মুক্ত এলাকা রৌমারী পাকিস্তানী বাহিনীর হুমকির সম্মুখীন হয় এবং তিনি তাঁর দু'টি ব্যাটালিয়ানকে রৌমারী রক্ষায় নিযুক্ত করেন। ‘জেড' ফোর্স গঠিত হবার অল্প সময় পরে মেজর জিয়াউর রহমান কতিপয় দুঃসাহসিক অভিযান চালান যা স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অংশের দাবী করতে পারে।

 আগস্ট মাসের শুরুতে মেজর আবু তাহের মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়কল্পে সফরে বের হয়ে এই সেক্টরে আগমন করেন। এই এলাকায় অভিযানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি এই সেক্টরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতর থেকে তাঁকে সেক্টর কমাণ্ডার নিযুক্ত হয়ে তিনি কামালপুর জামালপুর, টাংগাইল এবং ঢাকা সড়কের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। এর উপর ভিত্তি করে কামালপুরের বিপরীতে ভারতে মহেন্দ্রগঞ্জে এই সেক্টরের সদর দফতরে স্থাপন করেন। এখান থেকে তিনি কতিপয় বিখ্যাত আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করেন যা বিস্তারিত উল্লেখ করা যেতে পারে। এর মধ্যে চিলমারীর যুদ্ধ, কামালপুরের যুদ্ধ, তেরীখারীন যুদ্ধ, বাহাদুরাবাদ যুদ্ধ, দেশের অভ্যন্তরে টাঙ্গাইলের জাহাজ মারার যুদ্ধ, সরিষাবাড়ি যুদ্ধ, রংপুর অভিযান এবং নেভাল কমাণ্ডো অভিযান উল্লেখযোগ্য।

 আগস্ট মাসের শেষ দিকে এবং সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে এই সেক্টরের সমস্ত সেক্টর ট্রুপস, মুক্তিযোদ্ধা এবং ‘জেড' ফোর্স নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা করা হয়েছিল যাতে দেশের অভ্যন্তরে গণযুদ্ধের রূপ দেওয়া যায়। তারপর স্বাভাবিকভাবে ঢাকা অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এজন্য অন্যান্য সেক্টরেও ভারতীয় এলাকা ত্যাগ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী মেজর জিয়াউর রহমান যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরী করেন, যা লেঃ জেনারেল অরোরা ও অন্যান্য ভারতীয় সামরিক উচ্চ অফিসারবৃন্দ কর্তৃক খুব প্রশংসিত হয়েছিল। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে মুজিব নগরে সেক্টর কমাণ্ডার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, যার ফলে সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। পক্ষান্তরে সকলকে বিস্মিত করে কর্ণেল জিয়াকে তার 'জেড' ফোর্সসহ এই সেক্টর থেকে সিলেট পাঠিয়ে দেয়া হয়। 'জেড' ফোর্সের এই স্থানান্তর ১১ নং সেক্টরের জন্য ছিল সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত। মুক্ত এলাকা প্রতিরক্ষা ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধ দ্রুতগতিতে দেশের অভ্যন্তরে বিস্তার লাভ করতে পারেনা। ‘জেড’ ফোর্স চলে যাবার পর এই সেক্টরে মাত্র ২ জন নিয়মিত অফিসার অবস্থান করেন- স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ ও লেঃ মান্নান। নানা অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই সেক্টর উল্লেখযোগ্য অপারেশনে অংশগ্রহণ করে।

 ১৫ ই নভেম্বর আমি ১১নং সেক্টরে পৌঁছি এবং মেজর তাহেরের অবর্তমানে অস্থায়ীভাবে সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করি। সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে আমি সেক্টরের গুমোট, নির্জীব অনিশ্চয়তার মধ্যে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের দেখতে পাই। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তাদের নেতাকে হারিয়ে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছিল। আমি এসে হেডকোয়ার্টার সাবসেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎ করি। বিস্তারিত যুদ্ধের অবস্থা অবলোকনের পর আমি কর্মপদ্ধতি স্থির করি এবং আক্রমণাত্মক অভিযান পরিত্যাগ করে অবরোধমূলক অভিযান পরিচালনার জন্য ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে পরামর্শ পাঠাই। সমগ্র সীমান্ত এলাকাতে অভিযান শুরু করে।

 কামালপুরের অবরোধ ১৩ নভেম্বরের ২৩ তারিখ দিবাগত রাতে কামালপুরে অবরোধ করা হয় এবং পাকিস্তানের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি কামালপুরকে তাদের মূল বাহিনী থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং রসদ বন্ধ করে দেয়া হয়। এই অবস্থায় ১১ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ৪ঠা ডিসেম্বর বিকাল ৩টার সময় কামালপুর মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। নিয়মিত বাহিনীর ২২০ লোক এবং বিপুল অস্ত্র শস্ত্রসহ পাকসেনারা বন্দী হয়। এই অবরোধ চলাকালে তারা ১১ দিনের মধ্যে ৭ দিন বাইরে আসার চেষ্টা করলে বিপুল বাধার সম্মুখীন হয়ে