পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
470

করার কোন কথা ছিল না। তিনি ফায়ার বন্ধ করলেন। সম্ভবতঃ রেঞ্জিংয়ে কোন ডিফিকাল্টি ছিল, যার জন্য এটা হয়েছিল। পরে তাঁকে আমি ফায়ারিং কারেকশন জানাই। তখন সকাল হয়ে আসছে। কর্নেল তাহের এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন লেঃ মিজানের সাথে আমার কোন যোগাযোগ আছে কিনা। আমি বললাম এখন নেই। তিনি বললেন তাকে কল দাও, আমিও তার খোঁজ নিচ্ছি। তিনি ৫/৬ জনকে নিয়ে মিজানের পজিশনের দিকে গেলেন। প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে ঘণ্টাখানেক পর আমি সেটে কান্নার আওয়াজ শুনতে পারলাম। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বেলাল বলতে লাগলো শেলিং-এ তাহের ভাইয়ের পা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। মিজানের পজিশনের কাছে পাকিস্তানীরা তাকে দেখতে পেয়ে ৬০ এম-এম মর্টার থেকে শেলিং করে। তার একটি পা নষ্ট হয়ে যায়। ৩০/৪৫ মিনিট পর একটি হেলিকপ্টার এস কর্নেল তাহেরকে নিয়ে যায়। ১০-১১টা পর্যন্ত সেই পজিশনে থাকলাম। পরে আমার কাছে এক মেসেঞ্জার একটা কাগজ নিয়ে আসেন, কর্নেল তাহেরের লেখা। তাতে লেখা ছিল আমাকে এই সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। লেখাটুকু পুরোপুরি স্মরণ নাই। সম্ভবতঃ এ ধরনের “Clear the road from here to Dacca. Look after my bodys. I leave everything to you and God bless you." আরও অনেক কিছু ছিল। আমি অত্যন্ত মর্মাহত হলাম। কারণ আজ এই সেক্টরের দায়িত্ব আমার উপর দেয়া হয়েছে। আমি জানি না এই দায়িত্ব আমি সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারবো কিনা। আমার মনে হচ্ছিল যেন আকাশটা আমার মাথায় ভেঙ্গে পড়েছে। যা হোক, সেই অবরুদ্ধ অবস্থায় আমরা বিকেল পর্যন্ত সেখানে থাকলাম। স্কোয়াড্রন লীডার হামিদউল্লাহকে এই দায়িত্ব না দিয়ে আমার উপর তিনি এই দায়িত্ব দেন। অবশ্য পরে হামিদউল্লাহ আসার পর তিনি নামে মাত্র কমাণ্ডার রইলেন। অপারেশনের দায়িত্ব আমার উপর দেন, কারণ তিনি বিমানবাহিনীর লোক। অপারেশনের এইসব ব্যাপারে তিনি ততো অভিজ্ঞ নন। কর্নেল তাহের আহত হওয়ার আমরা সবাই মর্মামত হই। একটা বিরাট শূন্যতারও সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকটা গোটা পরিবার আকস্মিক পিতৃহীন হয়ে পড়ার মত। যাহোক অনেক কষ্টে আমি এই পরিস্থিতি সামলে নিয়ে ছিলাম। কর্নেল তাহের গৌহাটিতে চিকিৎসাধীন থাকাকালে আমি সেখানে গিয়ে তার সাথে দেখা করে যুদ্ধ বিষয়ক পরামর্শ করি এবং সেক্টরে ফিরে আসি।

 ডিসেম্বরের তিন তারিখ ভারত আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১ তারিখ থেকে আমরা কামালপুর অবরুদ্ধ করে রাখি। আমাদের সাথে ছিল এক ইণ্ডিয়ান রেগুলার ব্যাটালিয়ান, মুক্তিযোদ্ধা তিন কোম্পানী। আর ৯৫ মাউণ্টেন ব্রিগেডের দুইটি ব্যাটালিয়ন কামালপুর বাইপাস করে কামালপুর পতনের আগেই বক্সিগঞ্জের দিকে চলে যায়। তখন পাকবাহিনী বক্সিগঞ্জ থেকে পিছু হটে যাচ্ছে। ৪ তারিখ সকালে ইণ্ডিয়ান এয়ারফোর্সের দুটি বিমান কামালপুরের উপর স্ট্রাফিং শুরু করে। দ্বিতীয়বার আক্রমণ হয় ১২টা কি ২টায়- তৃতীয়বারের আক্রমণের কথা ছিল বিকাল চারটায়। ইতিমধ্যে পাকিস্তানী বাহিনী যথেষ্ট হেস্তনেস্ত হয়েছে। আমরা অয়্যারলেস সেটে ইণ্ডিয়ানদের কনগ্র্যাচুলেশন শুনছিলাম। এক পর্যায়ে কামালপুরে তাদের যে ফোর্স ছিল তারা কণ্টাক্ট করে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের সাথে এবং সাহায্য চেয়ে পাঠায় ফোর্সের জন্য। তারা জানালো তাদের কিছু করণীয় নাই। এটা বুঝে তখন জেনারেল হিরা, ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও আমি তিনজনে বসে বুঝাপড়া করে একটা সারেণ্ডার নোট তৈয়ার করি। একজন ফ্রিডম ফাইটারকে একটি সাদা ফ্ল্যাগ হাতে দিয়ে তা কামালপুর ঘাঁটি ভিতর পাঠাই। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে সে যখন ফেরে নাই, তখন আমি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লাম। দ্বিতীয়বার আর একটি ছেলেকে অয়ারলেস সেট সাথে দিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ রেখে কামালপুর ঘাঁটিতে পাঠাই। সে ওখানে যাওয়ার পর পাকসেনার দ্বিতীয় ছেলেটিকে রেখে প্রথম ছেলেটিকে পাঠিয়ে দেয়। তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করি। সে জানালো, আমাকে তারা উপরে শেলিং হচ্ছে বলে নীচে বাংকারে নিয়ে যায়। রুটিটুটি খেতে দেয়। তারা আমার সাথে ভাল ব্যবহার করে। যা হোক দ্বিতীয় ছেলেটির সাথে কয়েকবার সেটে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। সে তখন তাদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত ছিল। তাছাড়া তারা তাকে সেটে কথা বলতে দিতে এলাউ করেনি। কিছুক্ষন পর সে যখন সেটে আসলো তখন যোগাযোগ হলো। ছেলেটি জানালো তারা সারেণ্ডার করতে প্রস্তুত আছে। তখন আমি তাকে বললাম যে, আমি আর একজনকে পাঠাচ্ছি, তাদের জে-সি-ও বা অফিসার লেবেলের কাউকে তার সাথে আসতে বলো। সে গেল। যাওয়ার পর পাকিস্তান