পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
479

মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) মঈন এবং তার সাথে ছিলেন কর্নেল (বর্তমানে মেজর জেনারেল) জিয়াউর রহমান। সম্ভবতঃ ব্রিগেডের প্রথম এ্যাটাক সরেজমিনে তদারক করার জন্য কর্নেল জিয়া নিজেও এ্যাটাকিং ট্রপসের সাথে রওনা হন। আক্রমণের এইচ-আওয়ার ছিল ৩০/৩১শে জুলাই-এর রাত ৩-৩০ মিনিট। কিন্তু গাইডের অভাবে প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল এফ-ইউ-পি” তে সময়মত পৌছাতে পারেনি। ফলে ৩-৩০ মিনিটের সময় টাইমপ্রোগ্রাম মোতাবেক আমাদের নিজস্ব আর্টিলারী ফায়ার যখন শুরু হয় (ফায়ারের সংকেতধ্বনি ছিল হিস করে অয়ারলেসের উপর শব্দ করা) তখনও আমাদের ছেলেরা এফ-ইউ-পি তে পৌছার জন্য প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে। কাদামাটিতে এতগুলো লোকের এই দৌড়াদৌড়ির ফলে যথেষ্ট শব্দ হয়, তাতে করে দুশমনের পক্ষে আক্রমণের ডাইরেকশন নির্ধারণ করা একেবারে সহজ হয় এবং নিমেষের মধ্যে তাদের আর্টিলারী ফায়ার এসে পড়তে থাকে। এদিকে প্লাটুন পর্যায়ে ডেপথ (টু-আপ) হওয়ার ফলে লোক আগে-পিছে হয়ে যায়। ফলে কমাণ্ড কণ্ট্রোল কায়েম করা মুশকিল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এসেম্বলি এরিয়া থেকে পূর্ব নির্ধারিত এফ-ইউ-পি তে আসার মাঝপথে আমাদের নিজস্ব আর্টিলারী ফায়ার শুরু হওয়াতে প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল তৎক্ষণাৎ সেই অবস্থাতেই কোনক্রমে ফর্ম-আপ হতে থাকে। ফলে সে কি চিৎকার আর হট্টগোল। আবার ডাইরেকশনের অভাবে এডভান্স করাকালীন একে অন্যের উপর চড়ে বসে। আর অপেক্ষাকৃত নীচু কর্দমাক্ত জমির উপর আসার সাথে সাথে পাকিস্তানী ও আমাদের যুগ আর্টিলারী ক্রস-ফায়ারিং-এর নীচে আসার ফলে আমাদের বেশকিছু ছেলে হতাহত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে অয়ারলেস সেট জ্যাম হওয়াতে সংযোগ সম্পূর্ণরুপে বিচ্ছিন্ন হয়। তাতে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌছায়। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল হাটবাজার বসেছে আর নীলকর আদায়কারী সাহেবদের দেখে কে কোথায় পালাবে পথ পাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রথম ইষ্ট বেঙ্গলের পক্ষে আক্রমণের ব্যুহ রচনা করা আদৌ সম্ভব ছিল না। বরং সৈন্যদের পক্ষে পালিয়ে আসাটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। কারণ এ্যাটাকিং ট্রপস যদি ঠিকমত ফর্ম-আপ না হতে পারে তবে তাদের পক্ষে আক্রমণ করার প্রশ্নই ওঠেনা। ১৯৬৫ সনের যুদ্ধে বার্কি সেকটর বিআরবির ওপারে ভারতের এক ডিভিশন সৈন্য যখন ফর্ম-আপ হচ্ছিল তদানীন্তন পাকিস্তান তিনটি মাত্রা ট্যাংক আচম্বিতে সে সৈন্যদলের উপর হামলা চালায়। ফলে, ভারতীয় পালিয়ে যায়। যুদ্ধের ময়দানে এ ঘটনা অহরহ ঘটেছে এবং ঘটবে। এদিকে কর্নেল জিয়াউর রহমান বাঘের মত গর্জে উঠলেন, কাম অন, এ্যাট এনি কষ্ট উই উইল লাঞ্চ দি এ্যাটাক"। মেজর মঈন (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) আয়ারলেস ছেড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলেন। আর ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন ও হাফিজ এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। একদিকে প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল প্রসিডিউরের চামড়া পর্যন্ত তুলে ফেলছে, অন্যদিকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মেগাফোনে বাংলা-ইংরেজী-উর্দুতে মিশিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল তার সৈন্যদলকে। কারুর বা কলার ধরে লাইন সোজা কারে আগের দিকে (টারগেটমুখী) মুখ করে দিচ্ছে, আর কাউকে বা হাফিজ স্টেনের বাঁট দিয়ে মারছে। মোগল-রাজপুতের প্রথম যুদ্ধে আশিটি যুদ্ধে বিজয়ী রানা সংগ্রাম সিংহের বিপুল রণাভিঙ্গ সৈন্যবাহিনীকে দেখে আকারে ছোট মোগল বাহিনী ভড়কে গিয়েছিল যুদ্ধের প্রারম্ভেই। কিন্তু ভেলকিবাজির মত বাবর সে সৈন্যবাহিনীকে বাগে এনে বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। তাই সামরিক নেতা হিসাবে ইতিহাসে বাবরের স্থান অতি উচুতে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন ও হাফিজের কৃতিত্ব বুঝি সেখানেই। মাঝে বিশৃংখলার মাঝে শুধুমাত্র মনের জোর ও অদম্য সাহসে বলীয়ান হয়ে সালাউদ্দিন ও হাফিজ প্রতিবন্ধকার ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজ নিজ কোম্পানীকে অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত সক্ষম হন এবং নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ আক্রমণ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন। যুদ্ধের ময়দানে ফলাফলটা সকল সবকিছুর সবকিছুর পরিমাপক নয়, বরং ঘটনাটি কিভাবে সংঘটিত হলো সেটাই সবচেয়ে লক্ষণীয়।

 দ্বিতীয় মহাসমরে মণ্টগোমারীর কাছে রোমেল চরমভাবে মার খেলেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস, মাইলের পর মাইল পশ্চাদপসরণ অভিয়ান অব্যাহত রাখতে হয়েছে রোমেলকে সকলের মনে অণুপ্রেরণা যোগায়। তাই বুঝি রোমেল শুধুমাত্র রোমেলই।