প্রয়াস আমরা করিনি এবং ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের মৃত্যুর পর পরই শত্রুরা ডিফেন্স ছেড়ে দিয়ে আমাদেরকে পাল্টা আক্রমণ করে, ফলে আমাদের হতোদ্যম, ক্ষতবিক্ষত সৈন্যরা আরো ভড়কে যায়, যার ফলে সালাউদ্দীনের লাশটাও ফেরত আনা সম্ভাব হয়নি- এমন প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও অতি অল্প সময়ের মধ্যেই শত্রুদের এই পাল্টা আক্রমণ সত্যই প্রশংসার যোগ্য। এ ধরনের আত্মরক্ষামূলক মনোভাবকে মিলিটারী ভাষায় 'এ্যাগ্রেসিভ ডিফেন্স' বলা হয়। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের আক্রমণ যেহেতু ডেলিবারেট ছিল সেহেতু আর্টিলারী ফায়ারে টাইম প্রোগ্রাম মোতাবেক কিন্তু আক্রমণকালে এ জিনিসটা প্রকট হয়ে উঠেছিল যে ইংগিতে বা ‘অনকল’ রাখাই যেন ভাল ছিল, তাতে করে মনে হয় মাঝপথে আর্টিলারীর ক্রস-ফায়ারে যে হতাহত হয়েছিল তা এড়ানো যেত। এতদসত্ত্বেও, কামালপুর আক্রমণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক চমকপ্রদ অধ্যায়ের সূচনা করে। এই আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত রেইড ও এ্যামবুশ করা ছাড়া বাংকারে বসে থাকা শত্রুর বিরুদ্ধে পরিপূর্ণভাবে মুখোমুখি লড়াইতে আমরা অবতীর্ণ হইনি। কিন্তু এই আক্রমণেই প্রমাণিত হল, বাঙ্গালীরা ব্রীজ উড়াতে কিংবা রাতের আঁধারে রেইড ও এ্যামবুশ করতে যেমন পারদর্শী, তেমনি হাতাহাতি যুদ্ধেও সমপারদর্শী। ঐ সময়ে এমন একটি এ্যাকশনের সবিশেষ দরকার ছিল। কারণ তখন পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আমরা পিছু হটতে সীমান্তের ওপারে চলে যেতে বাধ্য হই। কারণ তখন পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আমরা পিছু হটতে হটতে সীমান্তের ওপারে চলে যেতে বাধ্য হই। ফলে স্বভাবতঃই মনোবল কিছুটা ভেংগে পড়ে। তাই মনোবল চাংগা করার জন্য, বিশেষ করে আমাদের স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছেলেদের মনে সাহস বাড়ানোর জন্য এবং এ বিশ্বাস জন্মাবার জন্য যে খান সেনাদেরকে বাংকার থেকে তাড়ানো তেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়, যদি কেউ গুলিতে ভয় না করে। সালাউদ্দীন মেজর প্রাণ দিয়ে আমাদের মনে এ প্রতীতি জন্মিয়েছিলেন। নির্যাতিত, অবহেলিত ও পদদলিত মানবতার প্রতীক স্পার্টাকাস হয়তো বা নিজে মরে যায় কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে জন্ম নেয় নিষ্পেষিত মানবাত্মার লেলিহান বহ্নিশিখায় ইতিহাসের অমর বীরেরা। তাই বুঝি সালাউদ্দীনের মৃত্যু বাংলাদেশের অগ্রগামীতার অভিযানে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়- আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল।
॥ নকশী বি-ও-পি আক্রমণ ॥
৩রা আগস্ট আমি ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ব্রেভো ও ডেল্টা এই দুই কোম্পানী যোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ করলাম নকশী বি-ও-পি। এর আগে আমি তিনদিন পুরা বি-ও-পি রেকি করেছি। নকশী বি-ও-পি'র পূর্বতন সুবেদার হাকিম ও তার সাথীরা আমাকে এ বিষয়ে সক্রিয় সাহায্য করেছেন। তার কারণ, এই বি-ও- পি তাদের নখদর্পণে ছিল।
প্রথম দিন আমি নিজে সুবেদার হাকিমসহ নকশী বি-ও-পি'র আশেপাশে রেকি একটি উঁচু টিলা থেকে। বাইনোকুলারে সুবেদার হাকিম আমাকে বলছিল কোথায় শত্রুদের বাংকার, বারবড আয়ার, বাঁশের কঞ্চি, মাইন ফিল্ড, কুক হাউস, মসজিদ ও বি-ও-পি'র প্রবেশ পথ, কোথায় কত সান্ত্রী থাকতে পারে ইত্যাদি। তারপর গারো পাড়ায় গিয়ে চুপি চুপি দেখা করলাম শত্রুশিবিরে আমাদের প্রেরিত বাবুর্চির সংগে। বাবুর্চি বললো, সে ৪৫ জন আর্মির খাওয়া পাকিয়েছে এবং আরো ৬৫ জন আর্মির লোক আসছে এবং ৫০/৬০ জন রাজাকারও বিভিন্ন ডিউটিতে আছে। দ্বিতীয় দিন প্লাটুন কমাণ্ডারকে নিয়ে আমি আবার স্বচক্ষে হালছটি গ্রাম, শালবন ও নালা পথ রেকি করে কোথায় কোন হাতিয়ার হবে এবং কোথায় এফ-ইউ-পি'র (ফর্ম আপ প্লেস) হবে সকলকে পই পই করে দেখিয়ে দিলাম। পহেলা আগস্ট আমি পুরো সেকশন কমাণ্ডারদের নিয়ে পূর্ব নির্দিষ্ট জায়গা আবার দেখিয়ে দিলাম যাতে করে রাতের আধাঁরে ভুল না করে। এদিকে সাপোর্টিং হাতিয়ার মেশিনগান, ১০৬ মিঃ মিঃ ও ৭৫ মিঃ মিঃ আর-আর-এর জন্য বাংকার বানাবার জন্য ২৫টি আড়াইমণী চটের বস্তা নিয়ে এলাম। এত প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়েছিল শালবনের ঘন আড়ালের জন্যই। অবশ্য পাকিস্তানীরা উত্তর দিকে বি-ও-পি'র চতুর্পাশ্বে প্রায় ৬০০ গজ এলাকায় সমস্ত গাছপালা, জংগল পরিষ্কার করে ফিলিং জোনের ফিল্ড অব ফায়ার একেবারে সাফ রেখেছিল। তৃতীয় দিনে রেকি করার কালে হালছটি গ্রামের নালার পাশে আমরা তখন একটি আমগাছের মাথায় লাল ফুলকে মানুষ (টাইপার) মনে করে থমকে দাঁড়ালাম। পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে এক গাল হাসি হাসতে যাব এমন