পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
503

এবং একটানা হাঁটার ফলে আমাদের সৈন্যরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবুও বিপুল উৎসাহ এবং আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা চা বাগানের ভিতর প্রবেশ করি। চিকনাগুল’ চা বাগানে আমরা মোজাহিদ কোম্পানীকে লেফট্যানেণ্ট মুদাসসির-এর নেতৃত্বে রেখে হেলিকপ্টারযোগে খাদ্যদ্রব্য এবং রসদ সংগ্রহ করার জন্য। আয়ারলেসের মাধ্যমে মেসেজ দেওয়া সত্ত্বেও আমরা কোন সাহায্য পেলাম না। শত্রপক্ষ কালগুল চা বাগানে আমাদেরকে বাধা প্রদান করে এবং আমাদের অলপ কয়েকজন যোদ্ধা হতাহত হন। তখন আমরা এ শত্রু ঘাঁটি এড়িয়ে যাই এবং ১৪ই ডিসেম্বর ভোরে সিলেট শহরে ঢুকে এম,সি, কলেজ এলাকায় প্রবেশ করি। এম,সি, কলেজে শত্রর অত্যন্ত শক্ত ঘাঁটি ছিল। আমরা শত্রপক্ষ থেকে পাঁচশত গজ দূরে এম, সি, কলেজের উত্তর দিকে টিলাগুলোর উপর ডিফেন্স নিই। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সামনে ছিল ‘বি’ কোম্পানী এবং ‘সি’ কোম্পানী- যথাক্রমে আমার এবং ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে। পিছনে ‘বি’ কোম্পানী এবং ‘সি’ কোম্পানী যথাক্রমে ক্যাপ্টেন নূর এবং লেফটেন্যাণ্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে ছিল। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারসহ মেজর জিয়াউর রহমান এ চার কোম্পানীল মাঝামাঝি একটি টিলার উপর অবস্থান করছিলেন। আমাদের সাথে মিত্রবাহিনী আটিলারীর একজন ব্যাটারী কমাণ্ডার ছিলেন। কিন্তু আয়ারলেস সেটের মাধ্যমে তিনি তাঁর গান পজিশনের সাথে যোগাযোগ রাখতে ব্যর্থ হন। এ সময় আমাদের ৩" মর্টারের মাত্র ১৪টি গোলা অবশিষ্ট ছিল। প্রায় তিনদিন আমাদের সৈন্যরা বলতে গেলে অনাহারে ছিল, তথাপি শত্রর নাকের ডগায় ট্রেঞ্জ খুঁড়ে পজিশন নিতে থাকে। শত্রপক্ষ আমাদের অতি নিকটে ছিল এবং নির্বিকারে কার্যকলাপ লক্ষ করছিল। তারা চিন্তাও করতে পারেনি যে আমরা মুক্তিবাহিনীর দল। কারন আমাদের পোশাক, ষ্টীল হেলমেট। অস্ত্রশস্ত্র তাদের মতই ছিল। তাছাড়া এ সময় যুদ্ধ চলছিল আমাদের পিছনে এবং বা দিকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে খাদেমনগরে। আমরা শত্রর পজিশনের ভেতর দিয়ে এত তাড়াতাড়ি সিলেট শহরে প্রবেশ করব তা ভাবতেও পারিনি। এটু পরে চিৎকার করে তারা আমাদের পরিচয় জানতে চাইলে আমরা তাদের চিৎকারের জবাব না দিয়ে চুপচাপ ট্রেঞ্চ খুঁড়তে থাকি। এ সময় ‘ডি’ কোম্পানীর পজিশনের সামনের রাস্তায় একটি আর্টিলারী গান ও দুটি জীপের কনভয় থামে। তখন ডি’ কোম্পানীর কমাণ্ডার মর্টারের সাহায্যে উক্ত কনভয়ের উপর গোলাবর্ষণ করেন, যার ফলে একটি জীপে আগুন ধরে যায়। শত্র তখন আমাদের উপর সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক-সেদিক চলাফেরা করতে থাকে। এ সুযোগে আমরা মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগান দিয়ে তাদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকি। ফলে পাকবাহিনীর ২৫ জন সৈন্য রাস্তার উপরেই হতাহত হয়। শত্রপক্ষ তখন মর্টারের সাহায্যে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে মৃতদেহ সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তখন আমাদের নিখুত গুলিবর্ষণের ফলে শত্রপক্ষের আরও বেশকিছু সৈন্য হতাহত হয়। দুপুরের সময় শত্ররা বাধ্য হয়ে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে এবং মর্টারের প্রবল গোলাবর্ষণের সাহায্যে আমাদের কোম্পানীর (‘বি’ কোম্পানী) উপর প্রচণ্ড আক্রমন চালায়। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের মর্টারের গোলা শেষ হয়ে যায়। তবু আমরা মেশিনগান, হালকা মেশিনগান, এবং রাইফেলের সাহায্যে দৃঢ়তার সাথে শত্রর আক্রমন প্রতিহত করি। এ আক্রমণের ফলে পাকবাহিনীর প্রায় ৮০ জন সৈন্য নিহত হয় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। আমাদের ‘বি’ কোম্পান এবং ‘ডি’ কোম্পানীর মোট ২০ জন সৈন্য শহীদ হন এবং প্রায় ২০ জন গুরুতরভাবে আহত হন। আমার কোম্পানীর সবচেয়ে সুযোগ্য সুবেদার ফয়েজ আহমদ অসীম সাহস এবং রণকৌশল প্রদর্শন করে শহীদ হন। তাঁকে “বীর উত্তম” খেতাবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এ যুদ্ধে সিপাই বাচ্চ মিয়া, পরিচয় দিয়ে শহীদ হন।

 এ যুদ্ধে নিম্নলিখিত যোদ্ধাগণ অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন এবং বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁদেরকে খেতাবে ভূষিত করেন। তাঁরা হলেনঃ ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারী (বীর প্রতিক), নায়েক সুবেদার হোসেন আলী তালুকদার (বীর প্রতিক), হাবিলদার নুরুল হক (বীর বিক্রম), শহীদ সুবেদার ফয়েজ আহম্মদ (বীর উত্তম), হাবিলদার সাইফুদ্দীন (বীর প্রতীক), হাবিলদার রুহুল আমীন (বীর প্রতীক), হাবিদলদার আবদুল গফুর (বীর প্রতীক) সুবেদার খাইরুল বাশার (বীর প্রতীক), নায়েক