পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
29

তোলে। এই দুটি ছিলো ৩৬ এবং ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশন। ১৯৭১-এর অক্টেবরের মধ্যে পাকিস্তান এখানকার সবগুলো ডিভিশনের পুনর্গঠন কাজ সম্পন্ন করে। ডিভিশনগুলোর সাথে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে ছিলো গোলন্দাজ ও ভারী মর্টার বহর এবং ট্যাংক বহর। আমেরিকান শেফি ট্যাংক চিলো ৬০টি। বিমান বাহিনীতে ছিলো ২০ খানি এফ-৮৬ স্যাবর জেট এবং নৌবাহিনীতে ছিলো অজ্ঞাত সংখ্যাক গানবোট এবং অন্যান্য উপকূলীয় নৌযান।

 এর মোকবিলায় ভারত তার ৭টি পদাতিক ডিভিশনকে এই এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য নিয়োজিত করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্রণ্টে আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং চীন সীমান্তে সম্ভাব্য হামলা মোকবিলায় প্রয়োজনীয় সৈন্য নিয়োজিত করার পর বাংলাদেশে যুদ্ধ চালনার জন্য ভারতের হাতে এই ৭টি পদাতিক ডিভিশন ছাড়া আর কোনো নিয়মিত ফোর্স ছিলো না। এইগুলোর মধ্যে ৬টি ছিল পুর্ণাঙ্গ ডিভিশন এবং ২টি স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেড। ডিভিশনগুলোকে যুদ্ধে পূর্ণ সহায়তা দেয়ার জন্য ছিলো হালকা এবং মাঝারি পাল্লার গোলন্দাজ বহর, পিটি-৭৬ ধরনের উভচর ট্যাংকের দুইটি রেজিমেণ্ট এবং টি-৫৪ ধরনের একটি ট্যাংক রেজিমেণ্ট। এছাড়া ৩টি স্বতন্ত্র ট্যাংক স্কোয়াড্রন এবং দুটি দ্রুত চলাচলে সক্ষম (মেকানাইজড) ব্যাটালিয়নকে যুদ্ধের জন্য নিয়োজিত করা হয়।

 ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৭টি জঙ্গী বোমারু বিমানের স্কোয়াড্রন এই এলাকার জন্যে নিয়োজিত করা হয়। এছাড়া ছিলো সৈন্য পরিবহনের জন্য কিছু সংখ্যক হেলিকপ্টার। বিমানবাহিনী জাহাজ আই.এন.এস ভীক্রান্ত সহ ইস্টার্ন ফ্লীট ছিলো এই অঞ্চলের সমুদ্রে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। বাংলাদেশের উপকূলের অদূরবর্তী সমগ্র সাগর এলাকা অবরোধের দায়িত্বে ছিলো এই ইস্টার্ন ফ্লীটের উপর ন্যস্ত। যুদ্ধ যদি শুরু হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে সৈন্য কিংবা সমসরঞ্জাম নিয়ে আসা নিয়াজীর পক্ষে আর কিছুতেই সম্ভব হবে না।

 এটা সাধারণ মাপকাঠি হিসাবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যে কোনো আক্রমণ পরিচালনা করে সফলতা অর্জন করতে হলে প্রতিটি আত্মরক্ষাকারী সৈনিকের বিরুদ্ধে তিনজন আক্রমণকারী নিয়োগ করতে হবে। পূর্বাঞ্চলে ভারত কিন্তু সেই অনুপাতে পাকিস্তানের চাইতে শক্তিশালী ছিল না। অনুপাত যেখানে ৩:১ হওয়া দরকার, সেখানে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনামূলক অনুপাত ছিলো ২:১। কিন্তু ইস্টার্ন কমাণ্ডার লে. জেনারেল অরোরা যে ৭টি ডিভিশন পেয়েছিলেন তার চাইতে বেশী সৈনিক পাওয়ার আর কোনো আশাই করতে পারতেন না এবং এই বাহিনী দিয়েই তাকে তার আরদ্ধ কাজ সমাধা করতে হবে। এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।

 তবে জেনারেল অরোরার আস্থা ছিল জয়ী তিনি হবেনই। বাংলাদেশের সমগ্র বাহিনী তাঁর সহযোগিতায় প্রস্তুত ছিলো। এর মধ্যে নিয়মিত ব্রিগেডগুলো ছিলো কে ফোর্স, এস ফোর্স এবং জেড ফোর্স। ৯টি সেক্টরের ২০ হাজার বাঙালী সেক্টর ট্রপস অস্ত্র হাত প্রস্তুত। এক লাখ গেরিলা সর্বত্র শত্রুকে তখন তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিলো। সর্বশেষ এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের জন্য তৈরি হয়েছিলো। ইয়াহিয়া কিংবা নিয়াজীর জন্য তাদের অন্তরে করুণার লেশমাত্র অবশিষ্ট ছিলো না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগেই বাঙালীদের এই ঘৃণা পাকিস্তানের পরাজয় এক রূপ নিশ্চিত করে রেখেছিলো।

 জনসাধারণের সমর্থনের ওপর ভিত্তি করেই প্রধানত ভারতের বিজয় নিরূপণ করা হয়েছিলো। জনসাধারণের একটি বিরাট অংশ ততোদিনে রাইফেল, এলএমজি, স্টেনগান ইত্যাদি চালানো কিংবা গ্রেনেড নিক্ষেপের কায়দা কানুন শিখে ফেলেছিল। শত্রুপক্ষের খবরা খবর সংগ্রহ করা এবং প্রায় সকল ধরনের অস্ত্রের পরিচিতি সম্পর্কে তারা মোটামুটি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। কোন অস্ত্রটি কোন দেশের তৈরী তাও অনেকে বলতে পারতো। আমার ২ নাম্বার সাবসেক্টরে আট বছরের একটি ছেলে প্রায় প্রতিটি টহলদের পার্টির সাথেই স্কাউট হিসেবে কাজ করতো। দিনের বেলা সে একাই চলে যেতো শত্রুর সব কিছু দেখে আসার জন্য। ফিল্ড ম্যাপের ওপর আঙুল দিয়ে সে