পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
32

 চলেছিলো। রাত ৩টায় ভারতীয় বিমানগুলো ঢাকা এবং কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটির উপর প্রথম হামলা শুরু করে। ইতিহাসের আর একটি মহান স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনা হলো।

 যুদ্ধের প্রথম দিনে সকল রণাঙ্গনে পাকিস্তানীরা মরণপণ শক্তিতে আক্রমণ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলো। বেলা ১০ টার মধ্যে ভীক্রান্ত তার নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌচে যায়। কিছুক্ষণের মধ্য ৬টি ‘সী হক’ বিমান চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যস্থলগুলোতে আঘাত হানার জন্য ডেক থেকে উড়ে গেলো।

 পূর্ব সেক্টরে অর্থাৎ মেঘনার পূর্ব দিকের অঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্যদের ধ্বংস করার দায়িত্ব ভারতীয় ৪র্থ কোরের ওপর ন্যাস্ত ছিলো। এই সেক্টরে প্রধান সড়কপথে রণকৌশলগত প্রতিবন্ধকতা ছিলো দুটি স্থানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং লাকসামে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করতে পারলে পূর্ব সেক্টরের সকল পাকিস্তানী সৈন্য বিশেষ করে সিলেট ও মৌলভীবাজারের সৈন্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য। একই সঙ্গে লাকসাম আমাদের দখলে এলে কুমিল্লা গ্যারিসন চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। চাঁদপুর ও ফেনী দখলের দায়িত্ব ছিল ৪র্থ কোরের উপর। যুদ্ধ শুরু হওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই এই স্থান দখল করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। একই সঙ্গে উত্তরে শমসেরনগর বিমান ঘাঁটি, মৌলভীবাজার এবং সিলেটও মুক্ত করার দায়িত্ব এই কোরের ওপর ছিলো। ৪র্থ কোরের প্রাথমিক পরিকল্পনায় ঢাকা মুক্ত করার পরিকল্পনা ছিলো না। সে অনুসারে কোর কমাণ্ডার সগত সিং ৮ নং মাউণ্টেন ডিভিশনকে শমসেরনগর বিমান ঘাঁটি, মৌলভীবাজার এবং সিলেট শহর মুক্ত করার নির্দেশ দেন। করিমগঞ্জের নিকট সীমান্ত অতিক্রম করে ৮ম মাউণ্টেন ডিভিশনের একটি কলাম সিলেটের দিকে এবং অন্য একটি মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। শমসেরনগর বিমার ঘাঁটি মুক্ত হয় প্রথম দিনেই। পাকিস্তানীরা অবস্থা বেগতিক দেখে এই অঞ্চলের অধিকাংশ সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে।

 এই কোরের ৫৭তম ডিভিশনকে আগরতলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পর আখাউড়া মুক্ত করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পথে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কুমিল্লা এবং ময়নামতি মুক্ত করার কাজে নিযুক্ত ২৩ মাউণ্টেন ডিভিশনকে সাহায্য করাও ৫৭ ডিভিশনের দায়িত্ব ছিলো। তারপর মেঘনা নদীর তীরে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র চাঁদপুর এবং দাউদকান্দি করার লক্ষে যুদ্ধভিযান চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশও এই ডিভিশনকে দেওয়া হয়।

 এই সেক্টরে দক্ষিণে ফেনী শহর থেকে পাকিস্তানীরা এক সময় সন্তপর্ণে পালিয়ে যায়। সাথে সাথে আমার বাহিনী শহরটিতে প্রবেশ করে। ফেনী আমাদের হাতে চলে আসায় চট্টগ্রাম পাকিস্তানীদের সঙ্গে দেশের অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এসময় কুমিল্লা ও লাকসাম এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়।

 আমার সেক্টরে ফেনী এবং বেলুনিয়া এলাকা সম্পুর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানীরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে লাকসামের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এটাই হচ্ছে একমাত্র এলাকা (অর্থাৎ চট্টগ্রাম সেক্টর) যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোন নিয়মিত পুরো ব্রিগেড যুদ্ধে নিয়োজিত হয়নি। এখানে অভিযান চলেছে প্রধানত আমার তিন ব্যাটালিয়ন সেক্টর ট্রপস (যার মধ্যে থেকে ২ কোম্পানী ইতিপূর্বেই চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হয়েছিল) এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়নের শক্তির ওপর নির্ভর করে।

 বেলুনিয়া ও ফেনীতে আমাদের হাতে চরম মার খাওয়ার পর ৫৩ ব্রিগেডসহ পাকিস্তানের ১৫ বালুচ রেজিমেণ্ট ৬ই ডিসেম্বর লাকসামের দিকে পলায়ন করেছিলো। ৬ই ডিসেম্বর আমরা ফেনী মুক্ত করে চট্টগ্রামের পথে অগ্রসর হই। সামনে আমাদের ৬৫ মাইল পথ। শুভপুরের কয়েক মাইল দক্ষিণে ধুমঘাট রেল সেতুটি দখল করা এবং রক্ষা করার জন্য আমি সাথে সাথেই দুটি প্লাটুনকে পাঠিয়ে দেই ধুমঘাটের পথে। চট্টগ্রামের পথে অগ্রসরমান আমাদের মূল বাহিনীতে ছিলো আমার সেক্টরের তিনটি নিয়মিত এবং বাংলাদেশের একটি কামান বহর নাম ছিল মুজিব ব্যাটারী। (শেখ মুজিবর রহমানের নাম অনুসারে)। ভারতীয় বাহিনীতে ছিলো ২য় রাজপুত ব্যাটালিয়ন, বিএসএফ-এর একটি গোলন্দাজ রেজিমেণ্ট। এই সেক্টরে বাংলাদেশ বাহিনীর কমাণ্ডার