পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
547

 তৃতীয়ত, পাকিস্তানী সমরনায়করা তখনও বুঝতে পারেনি ভারতীয় বাহিনী ঠিক কোনদিন দিয়ে ঢাকা পৌছতে চাইছে। বরং তখনও তারা মনে করছে ভারতীয়বাহিনী সবদিক দিয়েই রাজধানী দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এবং তখনও ভাবছে ভারতীয় বাহিনী সীমান্তের মূল পাক ঘাঁটিগুলির উপরই আক্রমন চালাবে।

 চতুর্থত, ব্যাপক বিমান এবং স্থল আক্রমণে শত্রুপক্ষকে একেবারে বিহবল করে দেওয়া গিয়েছে।

 পঞ্চমত, পাক বিমান বাহিনীকে অনেকটা ঘায়েল করে ফেলা হয়েছে। তাদের বিমান ঘাটিগুলিও বিধ্বস্ত।

 ষষ্ঠত, পাকিস্তানের প্রধান নৌবন্দর গুলি অর্থাৎ চট্টাগ্রাম, কক্সবাজার, চালানা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জে জাহাজ বা ষ্টীমার ভেড়াবার ব্যাবস্থাও অনেকটা বিপর্যস্ত। এবং

 সপ্তমত, বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক এবং বাড়িঘরও মোটেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনী তাই যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনেও পূর্ব লক্ষ্য মতই এগিয়ে চলল।

 পশ্চিম দিকে থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিফৌজের সব ক'টা কলামপুরে এগিয়ে চলল। কিন্তু কোথাও তারা সোজাসুজি পাক ঘাঁটিগুলির দিক এগালো না। মূল বাহিনী সর্বদাই ঘাঁটিগুলিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল। এবং ঘাঁটিতে অপেক্ষমাণ পাকবাহিনী যাতে মনে করে যে ভারতীয় বাহিনী তাদের দিকেই এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে সেই জন্য প্রত্যেক পাক ঘাঁটির সামনে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর কিছু কিছু লোক রেখে যাওয়া হল।

 ওদিকে মূল ভারতীয় বাহিনী যে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানীরা সে খবরও পেল না। কারণ, প্রথমত, তাদের সমর্থনে দেশের লোক ছিল না, যার খবরাখবর দিত পারে। দ্বিতীয়ত, তাদের বিমান বাহিনীও তখন বিধ্বস্ত। সর্বএ উড়ে পাক বিমান ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতির খবরাখবর পাক সেনাবাহিনীকে জানতে পারল না। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে পাক বাহিনীর বেতার খবরাখবর পাঠাবার ব্যবস্থাও তেমন ভাল ছিল না। সুতারাং, নিজস্ব ব্যবস্থায়ও তারা খবরাখবর পেল না।

 তাই ভারতীয় বাহিনী যখন সোজাসুজি যশোর, হিলি, শ্রীহট্ট, কুমিল্লা, ফেনী প্রভৃতি শক্ত পাক ঘাঁটির দিকে না গিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল তখন পাক বাহিনীর অধিনায়করা তা মোটেই বুঝতে পারল না। বরং ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণের বহর দেখে তখনও তারা মনে করছে ভারতীয় বাহিনী সোজাসুজিই এগোবার চেষ্টা করছে। সেইজন্য তখনও তারা মূল সড়কগুলি আগলে বসে রাইল। সীমান্তের কাছাকাছি শহরগুলিতে তখনও পাকবাহিনীতে অধিষ্ঠিত একমাত্র কুষ্টিয়া জেলার দর্শনা ছাড়া। দর্শনা যে মুহুর্তে আমাদের ৪নং পাবত্য ডিভিশনের কামানের পাল্লার মধ্যে এসে গেল পাকিস্তানীরা অমনি শহর ছেড়ে আরও পশ্চিমে পালাল।

 এদিকে তখন ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীও প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। লড়াইয়ের দ্বিতীয় দিনেও ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি বার বার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভিতি এলাকায় সামরিক ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালাল। ঢাকায় সেদিনও জোর বিমান যুদ্ধ হল। কিন্তু সেইদিনই প্রায় শেষ বিমান যুদ্ধ। অধিকাংশ পাক বিমানই ঘায়েল হল। বিমান বন্দরগুলিও প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হল।

 ওদিকে তখন মিত্রবাহিনীও প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলেছে- প্রধান সড়ক এবং পাক ঘাঁটিগুলি এড়িয়ে। তখনও পর্যন্ত প্রধান লক্ষ্য, বাংলাদেশের চতুদি কে কে ছড়ানো পাকবাহিনীকে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছন্ন করে দেওয়া এবং আবার যাতে একত্র হয়ে ঢাকা রক্ষার জন্য কোন বড় লড়াইয়ে নামতে না পারে তার ব্যবস্থা করা।

 ৫ডিসেম্বর: লড়াইয়ের তৃতীয় দিনেই স্বাধীন বাংলার আকাশ স্বাধীন হয়ে গেল। বাংলাদেশে পাক বাহিনীর প্রায় সব বিমান এবং বিমানবন্দরই তখন বিধ্বস্ত। গোটা দিন ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলি অবাধে আকাশে উড়ে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলিতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাল। ভারতীয় বিমান বাহিনীর হিসাব মত বারো ঘণ্টায় দু'শ