পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
548

ত্রিশবার। তেজগাঁও এবং কুরমিটোলা বিমান ঘাঁটিতে পঞ্চাশ টনের মত বোমা ফেলল। কুরমিটোলা রানওয়েতে গোটা কয়েক হাজার পাউণ্ড বোমা ফেলায় ছোটখাটো কয়েকটা পুকুরই সৃষ্টি হয়ে গেল। পাক বিমান বাহিনীর শেষ স্যাবর জেট তিনটা ঐখানে আটকে ছিল। রানওয়ে বিধ্বস্ত হওয়ায় ছাউনিতেই সেগুলিকে আটকে থাকতে হয়। ভারতীয় বিমানের আক্রমণে সেদিন বড় রাস্তা দিয়ে পাক সেনাবাহিনীর যাতায়াতও প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। পাকবাহিনীর প্রত্যেকটা কনভয়ের উপর ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলি আক্রমণ চালাল। ওদের নবুইটা গাড়ি ধ্বংস হল। ধ্বংস হল পাকিস্তানী সৈন্য বোঝাই বেশ কয়েকটা লঞ্চ এবং স্টীমারও।

 জামালপুর আর ঝিনাইদহের পাক সামরিক ঘাঁটিও ভারতীয় বিমানের আক্রমণ বিধ্বস্ত হল।তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলের বিমানবন্দর ধ্বংস ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলি সারাদিন ধরে গোটা বাংলাদেশের সবকটা বিমানবন্দরে হানা দিল। উদ্দেশ্য, আর কোথাও পাক বিমান আছে কিনা খুঁজে দেখা। কিন্তু কোথাও আর একটা ও পাক বিমান খুঁজে পাওয়া গেল না। পরে নিজেদেরই অর্থাৎ মিত্রপক্ষেরই কাজে লাগবে এই ভেবে ভারতীয় বিমান বাহিনী অধিকাংশ বিমান বন্দরকেই অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দিল।

 পূর্ব খণ্ডে ভারতীয় নৌবাহিনী ও সেদিন বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। বঙ্গোপসাগরে পাক সাবমেরিন ‘গাজী’ সেদিন ভারতীয় নৌবাহিনীর আক্রমণ শেষ হল। সাবমেরিন 'গাজী' ছিল পাক নৌবহরের গর্বের বস্ত।

 ওইদিন ভারতীয় নৌবাহিনী প্রত্যেকটা নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজকে হুশিয়ার করে দিল। প্রধান হুশিয়ারীটা চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে বলা হলঃ আপনারা সবাই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে চলে আসুন। আপনাদের স্বার্থ এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমরা শনিবার চট্টগ্রাম উপর তেমন প্রচণ্ড ভাবে গোলাবর্ষণ করিনি। আজ রবিবার আপনাদের কথা চিন্তা করে আমরা শনিবার চট্টগ্রাম উপর তেমন প্রচণ্ডভাবে গোলাবর্ষণ করিনি। আজ রবিবার আপনাদের বন্দর থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কাল সোমবার আমরা প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ চালাব। সুতরাং কাল থেকে আপনাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে আমরা কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারব না।

 এই ‘ওয়ানিং’ এ দু'টো কাজ হল। (এক) বিশ্বের সব দেশ বুঝল বাংলাদেশের বন্দরগুলি রক্ষা করার কোনও ক্ষমতা আরপাক বাহিনীর নেই। এবং (দুই) ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ও বিমানগুলি বাংলাদেশের সব বন্দরকে ঘায়েল করার অবাধ সুযোগ পেল।

 এদিকে তখন স্থলে মিত্রবাহিনী ও এগিয়ে চলেছে। পাক স্থলবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। প্রধান সড়কগুলি দিয়ে না এগিয়ে ও ভারতীয় বাহিনী বিভিন্ন সেক্টরে প্রধান প্রধান সড়কের কতকগুলি এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি করল। ফলে, ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা ও রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। শুধু ঢাকার সঙ্গে যশোর এবং খুলনার যোগাযোগ তখনও অব্যহত। কতকগুলি ঘাঁটি সেদিন কিছুটা লড়াইও হল। একটা বড় লড়াই হল লাকসামে। আর একটাহল ঝিনাইদহের কাছে কোট চাঁদপুরে। দু'টো লড়াইয়েই পাক সৈন্যরা বেজায় মার খেল এবং ঘাটি দু'টো ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হল।

 এই দু'টো ঘাঁটি দখলের চেয়েও কিন্তু মিত্রবাহিনীর বড় লাভ হল পাকবাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থাটা প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দিত পারায়। এটাই ছিল প্রথম পর্যায়ে তাদের বড় লক্ষ্য, যাতে পাক সেনাবাহিনী কিছু হটে গিয়ে আবার না রিগ্রুপড় হতে পারে-ঢাকা রক্ষার লড়াইয়ের জন্য পদ্মা ও মেঘনার মাঝখানে কোন ও নতুন শক্ত ব্যূহ না রচনা করতে পারে। বিভিন্ন বড় সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে মিত্রবাহিনী সীমান্তের ঘাঁটিগুলি থেকে পাকবাহিনীর ঢাকার দিকে ফেরার পথ প্রায় বন্ধ করে দিল। এ ব্যাপারে তাদের আরও সুবিধা হল আকাশে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একাদিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়। গোটা বাংলাদেশের সব বড় সড়ক ও নদীর উপর তখন ভারতীয় জঙ্গী বিমান পাহারা দিচ্ছে। এবং পাক সেনাবাহিনীর কনভয় চোখে পড়লেই তাকে আক্রমণ করছে।

 এই রকম যখন অবস্থা তখন নিয়াজিও সবটা বুঝতে পারল। চতুর্দিক থেকে মিত্রবাহিনীর অগ্রগতির খবর পৌঁছল ঢাকায়। আর পৌঁছল পাকবাহিনীর বিপর্যয়ের সংবাদ। নিয়াজি আরও জানতে পারল যে মিত্রবাহিনীর