পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/২৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
২৬২

সেজন্য আমরা আছি, সমস্ত শক্তি দিয়ে আমরাও এগিয়ে যাব এবং সাহায্য করব। এই বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

 ডঃ জয়নাল আবেদীনঃ মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয়, হঠাৎ বন্ধুরা চঞ্চল হয়ে উঠলেন কেন বুঝি না। আমি শুধু অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আজকে এই বিতর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে হচ্ছে। এই বিতর্ক, আলোচনার সঙ্গে আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা জড়িত; শুধু ওপার বাংলার মানুষের নয়, আমাদেরও। তাই আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই যে, আজকে গভর্নরের এ্যাড্রেসের উপর আলোচনা হচ্ছে না।

 মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয়, আজকের এই এসেম্বলীর একটা শুভদিন। অন্ততঃ একটা বিষয়ে এই দুর্দিনে, এই দুর্দিন শুধু সীমান্তের ওপারেই সীমাবদ্ধ নয়, যে ধারায় এই সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে, তার যে সম্ভাব্য পরিণতি তাতে আমরাও বিপদমুক্ত এ কথা বলতে পারি না। এই জন্য শুভদিন বলছি, বিরোধী পক্ষের বন্ধুরা একদিনের জন্য এই গরমিল নিয়েই আলোচনার সূত্রপাত করতে চাই। বাংলাদেশের সংগ্রাম প্রাথমিক পর্যায়ে অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলনই ছিল। জ্যোতিবাবু বলে গিয়েছেন দ্বিজাতিতত্ত্ব ধুয়ে মুছে গেছে। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই এই ভুল থিওরী দ্বারা যে একটা সংকট সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে যে পক্ষ ছিল সে পক্ষ স্বার্থান্বেষী পক্ষ ছিল। নিশ্চয়ই তারা মুছে গেছে। আমরাও গর্বিত। এই আন্দোলনের যারা বিরোধিতা করেছিল সেই কংগ্রেস এই দ্বিজাতিতত্ত্ব বিশ্বাস করেনি বলেই, হিন্দু মুসলিম এই ভেদে বিশ্বাস করেনি বলেই আজকে কংগ্রেস দ্বিগুণ বলে বলীয়ান হয়ে এসেছে সর্বত্র; এ কথাটা তিনি বলে গেলেন না। কংগ্রেস আজকে এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেনি বলেই এক দিকে মুছার নিশানা আর এক দিকে বিপুল শক্তির সূচনা। এটার স্বীকৃতি দিলে খুশি হতাম।

 এখন যে-কথা বলছিলাম, এই সশস্ত্র সংগ্রাম বাংলাদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংগ্রাম অসহযোগ এবং ঐতিহাসিক পর্যায়ই রেখেছিল। হাইকোর্টের জজ, সুপ্রীম কোর্টের জজ গভর্নরের শপথ গ্রহণ করায়নি। সেজন্যই একদিন গান্ধীজী মন্ত্র দিয়েছিলেন আন্দোলন অসহযোগের দ্বারা, হিংসার দ্বারা নয়। কিন্তু আমাদের বিরোধী দলের বন্ধুরা হিংসা ছাড়া কোন সমস্যার সমাধান খুঁজে পান না। মাহাত্মা গান্ধী যে বাণী দিয়ে গেছেন তা হল অহিংস অসহযোগ-এর পথই একমাত্র পথ, এই পথে পৃথিবীর সমস্যার সমাধান সম্ভবপর। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয়, জোর করেই হোক যে রকম উপায়েই হোক এই সংগ্রাম সশস্ত্র পর্যায়ে চলে গিয়েছে। এর সম্ভাব্য পরিণতি কি হতে পারে? এই সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, মুক্তিফৌজের সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ইয়াহিয়া খাঁর বাহিনী একবার দখল করতে পারে, আবার মুক্তিফৌজ পাল্টা দখল করতে পারে। এই যে সংঘবদ্ধ অসম সংগ্রাম সাধারণ নাগরিক কৃষকমজুর সংঘবদ্ধ হয়ে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে দেরী লাগতে পারে, এই সংগ্রাম ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হবার পথেই যাচ্ছে। এর আর একটা পরিনতি হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে দালাল লাগিয়ে, মুসলিম লীগের লোকদের হাত করে বা নুরুল আমিনপন্থী যারা আছে তাদের হাত করে বা ওই জাতীয় এজেণ্ট যারা আছে তাদের হাত করে দেশের আন্দোলনকে নষ্ট করে দিতে পারে এবং বেয়নেট দিয়ে, প্রলোভন দিয়ে, ইয়াহিয়া বাহিনী সমস্ত দেশ দখল করতে পারে এবং তার ফলে আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা দেখছি আজকের এই যুদ্ধে মা এবং মেয়েরাও সামিল হয়েছেন। এইভাবে যদি তাঁরাও সামিল হন অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধের সামিল হন তাহলে এটা বাস্তব সত্য যে, এটা একটা পরিপূর্ণ রূপ নেবে। আজকে একটা জিনিস দেখছি আন্তর্জাতিক বৃহৎ শক্তিগুলি নির্বাক দর্শক হয়ে রয়েছে-কেউ কোন কথা বলছেন না এবং যদি বা কেউ কিছু বলেন তাহলে খুব সতর্কতার সঙ্গে বলছেন। আর একটা জিনিস দেখছি ওপারে যারা নিজেদের মহাশক্তি বলে বলছেন সেই মহাচীন এতে মদদ দিচ্ছেন এবং তাঁরা চাচ্ছেন এটাকে ডোর-স্টেপ ফর ইণ্ডিয়া করতে। আজকে মহাচীনের কথা বলাতে হরেকৃষ্ণ বাবু আপত্তি করেছেন। কিন্তু এর সম্ভাব্য পরিণতি অস্বীকার করবেন কি করে?