পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৮৭

 ওদিকে সাবরুমের সকল বেসামরিক বাসিন্দাকে ইতিপুর্বেই আরো অভ্যন্তরে নিরাপদ স্থানে অপসারণ করা হয়েছিলো। সারা তল্লাট জুড়ে বুলেট ছুটছিলো। ভারতীয় এলাকার বাড়িঘর এবং গাছপালায় গিয়ে গুলি লাগছিলো। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীবাহিণীও (বি-এস-এফ) ইতিমধ্যে যার যার ট্রেঞ্চের ভেতরে অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। তবে তারা সবকিছু অবলোকন করছিলো মাত্র।

 এ সময় শত্রুর একটি অয়্যারলেস বার্তা আমরা শুনতে পাই। ওতে বলা ছিল “রামগড়ের বিদ্রোহী হেডকোয়ার্টার দখল করেছি।”

 ২রা মে'র এই রাতে শত্রুরা রামগড়ের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সমগ্র বাজার এলাকা জ্বলে ওঠে। ঊর্ধ্বমূখী ধোয়ার কুণ্ডলী আর অগ্নিবলয়ের ভেতর দিয়ে দুরে তখন পাহাড় শ্রেণীর অস্পষ্ট রেখা চোখে পড়ছিলো সেখানেই আমাদের স্বপ্নের সেই দেশ যার জন্য আমরা যুদ্ধ করে চলেছি, অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যাব। কিন্তু কতদিন এ যুদ্ধ চলবে তা আমরা কেউ জানতাম না।

॥ শুভপুর সেতুর যুদ্ধ ॥

 রামগড় হারানোর বিপর্যয়ে আমাদের তখন মনমরা অবস্থা। হরিনায় বিকল্প সদরদফতর স্থানপন করতে পারলেও ভারতের আশ্রয়ে থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এ কথা যেনো কোনমতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। রামগড়ে আমাদের একটা সান্তনা ছিল যে, সেটা আমাদের নিজেদের দেশ। সেখানকার সবকিছুই আমাদের। কিন্তু হরিণা ভারতীয় এলাকা দুটির মধ্যে বিরাট পার্থক্য আমাদের সব স্বপ্ন বুঝি ভেঙ্গে গেলো। আমাদের কেউ কেউ শিশুর মত কেঁদেছিলো। মানসিক আঘাতে পাথর হয়ে যাওয়া অনেককে দেখেছিলাম একটা ঘোরের মধ্যে পা দুটি যেন টেনে নিয়ে হরিণার দিকে চলছে। কাধে ঝুলছে পুরনো দিনের হাতিয়ার এবং গুলিশুন্য থলে।

 এরপর প্রধান সড়কে শুভপুর সেতুর কাছে মারাত্মক লড়াই আসন্ন হয়ে ওঠে। ভারতীয় বি এস এফ বাহিনীর সহযোগিতায় সেতুর একটি অংশ আমরা এর আগে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। এখানে আমাদের দলে লোকসংখ্যা ছিল মাত্র একশর মত। এদের অধিকাংশই ছিল আবার সতদিনের ট্রেনিং প্রাপ্ত বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা। সেতু প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পড়েছিলো ই পি আর সুবেদার ফখরুদ্দিনের ওপর। আমাদের লক্ষ্য ছিল শত্রুরা যাতে এই গুরুত্বপূর্ন সেতু ব্যবহারের সুযোগ না পায় এবং ঢাকা ও কুমিল্লার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে না পারে।

 করেরহাটের পতনের পর সেতুর উত্তর দিক থেকে আমরা সৈন্য প্রত্যাহার করে সেতুর দক্ষিন দিকে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করি। আমরা জানতাম সেতুটি দখল করার জন্য শত্রুরা মরিয়া হয়ে উঠবে। করের হাটে তারা কামান মোতায়েন করেছিলো, কয়েকটি ট্যাংকও নদীর পার পর্যন্ত চলে এসেছিলো। দূর থেকে শত্রুপক্ষের কামানের গোলা এসে আমাদের ওপর পরছিলো। ট্যাংকগুলো অগ্রসর হয়ে আমাদের একটির পর একটি ব্যাংকার ধ্বংস করে চলছিলো। আমাদের ট্যাংক বিধ্বংসী কয়েকটি ছোট হাতিয়ার থাকলেও তখন তার কোন শেল আমাদের কাছে ছিল না।

 ট্যাংক ও কামানের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের ছত্রচ্ছায়ায় পাকিস্তানীরা কয়েকবারই নদী পার হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। দুবার তাদের সৈন্যরা নদীপথে মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে দু'দিকের গুলির মধ্যে পড়ে যায়। পরিস্কার দিনের আলোয় তাদেরকে দেখে দেখে আমরা গুলিবিদ্ধ করতে থাকি। অনেকটা যেন বেশ আরামের সাথে টার্গেট প্র্যাকটিস করার মতো এভাবে দুকোম্পানীরও বেশী সৈন্য আমরা নির্মূল করি। তাদের লাশগুলো নদী দিয়ে ভাসতে ভাসতে সাগরের দিকে চলে যায়। এই ভাবে লোকক্ষয়ের পর শত্রুরা নদী পার হয়ে সেতু দখলের চেষ্টা ত্যাগ করে।