পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৯০

তাৎক্ষনিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি মাত্র। অবশ্য আমরা ভেবেছি অন্য সবাইও হয়ত আমাদের মত এগিয়ে আসছিলেন। শুধু ক্যাণ্টনমেণ্টেই নয়, আমরা মনে করেছি সমস্ত বাঙ্গালীই এই যুদ্ধে ছিলেন। কারণ এটা ছিল বাঙ্গালী জাতির প্রশ্ন, বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন।

 প্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা বেতারে কখন প্রচারিত হয়েছে বলে আপনি বলতে চান?

 উঃ এটা একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণা যেটা নিয়ে সব সময় বিতর্ক চলতে থাকে যে জেনারেল জিয়া করেছেন, না আওয়ামী লীগ করেছেন। আমার জানামতে সবচাইতে প্রথম বোধ হয় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান ভাইয়ের কণ্ঠই লোকে প্রথম শুনেছিলেন। এটা ২৬শে মার্চ' ৭১ অপরাহ্ন দু'টার দিকে হতে পারে। কিন্তু যেহেতু চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রর প্রেরক যন্ত্র খুব কম শক্তিসম্পন্ন ছিল, সেহেতু পুরা দেশবাসী সে কণ্ঠ শুনতে পাননি। কাজেই যদি বলা হয়, প্রথম বেতারে কার বিদ্রোহী কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়েছিল। তা'হলে আমি বলব যে, চট্টগ্রামের হান্নান ভাই সেই বিদ্রোহী কণ্ঠ। তবে এটা সত্য যে পরদিন অর্থাৎ ২৭শে মার্চ ৭১ মেজর জিয়ার ঘোষণা প্রচারের পরই স্বাধীনতা যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়।

 প্রঃ ২৭শে মার্চ ৭১ মেজর জিয়াউর রহমান কি পরিস্থিতিতে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে সংগঠিত বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গেলেন এবং স্বাধীনতা ঘোষনা পাঠ করলেন?

 প্রঃ ২৫শে মার্চ ৭১ রাতে ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়ার পরই আমরা চট্টগ্রামে আমাদের অধীনস্থ সমস্ত ব্যাটালিয়নকে হাতে নিয়েছিলাম। আমরা ভেবে দেখলাম যে, নতুন পাড়া ক্যাণ্টনমেণ্টে পাকিস্তান বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ট্যাংক ছিল। আমরা ছিলাম ষোলশহরে মাত্র দু'মাইল দুরত্বে। আমরা দেখলাম, আমাদের হাতে কোনও ট্যাংক ছিল না। এবং কোন অস্ত্রশস্ত্রও আমাদের অর্থাৎ ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের হাতে ছিল না। ইতি পূর্বেই ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট পাকিস্তানে চলে যাবে বলে অধিকাংশ অস্ত্রই পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমাদের হাতে শুধু ছিল কিছু রাইফেল এবং এল এম জি ধরনের স্বল্পসংখ্যক অস্ত্র। ভারী কোনও অস্ত্র ছিল না। আমার সাথেই জেনারেল জিয়া আলাপ করলেন। আমরা আলাপ করে দেখলাম যে আমরা যদি ষোলশহর বিল্ডিং এর ভিতর অবস্থান করি এবং এই অবস্থায় যদি ট্যাংক আসে, তাহলে আমরা ট্যাঙ্ক ঠেকাতে পারব না। কারণ ট্যাঙ্ক ঠ্যাকানোর মত কোন অস্ত্রই আমাদের হাতে ছিল না। ট্যাঙ্ক থেকে দু তিনটা গোলা ছুড়লেই আমাদের অনেক সৈন্য মারা যাবে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাদের ঐ এলাকা থেকে বাইরে চলে যাওয়া উচিৎ এবং নিরাপদ দুরত্বে থেকে হেডকোয়ার্টার বেস বানানো উচিত। এ ছাড়া আমাদের অধীনস্থ জোয়ানতের শপথ নেয়া উচিত। শপথ নিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে তারপর যুদ্ধে যাওয়া উচিত। আমরা সোজা প্রথমে গেলাম কালূরঘাট। সেখানে ভোররাতের দিকে আমরা মার্চ করে গেলাম। তখন খুব কুয়াশা ছিলো এবং আল্লাহর কি ইচ্ছা সেদিন অর্থাৎ ২৬শে মার্চ' ৭১ এর সকার ৮টা কি ৯টা পর্যন্ত কুয়াশা ছিল। কালুরঘাটে পৌঁছে আমরা সবাই কনফারেন্স করলাম। এতে কিছু বি ডি আর অফিসার এবং জোয়ানও ছিলেন। এই কনফারেন্সে সিদ্ধন্ত নেয়া হল যে, আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে চট্টগ্রাম রক্ষার জন্য পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমন চালাব। আমাদের আক্রমনের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল পোর্ট এবং ক্যাণ্টনমেণ্ট। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতৃবৃন্দ আমাদের সাথে এসে যোগ দিয়েছিলেন। এই তো গেল ২৬শে মার্চ ৭১-এর কথা। ঐদিন আমরা খোজখবর নিয়েছিলাম কোথায় কি ঘটেছিলো। আমি একখানা জীপ নিয়ে পুরা শহর ঘুরে দেখলাম। আমি টহল দেয়ার সময় আগ্রাবাদের মোড়ে আমার জীপের ওপর একটি এল এম জি বার্ট ফায়ার এলো। আমি কোনও প্রকারে জীপ ঘুরিয়ে ফেরত গেলাম এবং জেনারেল জিয়াকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করলাম এবং সেভাবে আমাদের দলকে নিয়োজিত করলাম।

 ২৭শে মার্চ' ৭১ মনে হয় জোনরেল জিয়া বুঝতে শুরু করলেন যে বেতারে একটা ঘোষণা প্রচার করা দরকার। ঐ তারিখেই সন্ধ্যায় কালূরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে এটা করলেন তিনি। বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ