পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১১১

পলায়ন করে। আমরাও পাক সেনা বাহিনীর আখাউড়া অবস্থানে ছোট ছোট দল পাঠিয়ে ব্যতিব্যাস্ত করে তুলি। আমরা জানতে পারি যে, ব্রাহ্মণবড়িয়া থেকে ট্রালি বা লাইট ইঞ্জিনের মাধ্যমে পাকবহিনী তাদের রসদ এবং সরঞ্জাম আখাউড়াতে পাঠায়। এ খবর জানতে পেরে আমাদের ১টি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২ মাইল দক্ষিণে রেল লাইনের নিচে মাইন পুঁতে দেয়। কিন্তু পাকবাহিনী স্থানীয় দালালদের সহায়তায় এসব মাইন সম্মন্ধে জানতে পারে এবং সেগুলি উঠিয়ে নেয়। পাক বাহিনী এ সময়ে রেল লাইনের নিকটবর্তী গ্রামের লোকদেরকে কঠোর সতর্ক করে দেয় যে, কোন গ্রামের নিকটে মুক্তিবাহিনী যদি তাদের কোন ক্ষতিসাধন করে তাবে সে গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হবে। এ সতর্কতার ঘোষণায় প্রতিদিন রাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো হতে লোকজন লাইন এবং সড়ক পাহারা দিত। এর ফলে আমাকে পাকবাহিনীর গতিবিধির উপর বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।

 এ রকমের বাধাবিপত্তির সম্মুখীন আরো অনেক জায়গাতে আমি হই। আমাদের কাজ অব্যাহত রাখার জন্য যে সব জায়গায় আমার লক্ষ্যস্থল ছিল, সেখানে আমার সেনাদলগুললিকে সান্ধ্য আইন (কারফিউ জারি করার নির্দেশ দিই এবং এ নির্দেশ বহুলাংশে সফল হয়। যদিও গ্রামবাসীদের পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করার কোন ইচ্ছা ছিল না তারা তাদের ভয়ে এসব বাধাবিপত্তির সৃষ্টি করতো। আমাদের সান্ধ্য আইনের ঘোষণায় অনেক ফল হয় এবং গ্রামবাসীরা আর বাধা সৃষ্টি করে না। এরপর আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আখাউড়ার মাঝে ২টি রেল সেতু উড়িয়ে দিই। এর ফলে আখাউড়ায় পাকসেনাদের অবস্থানটির জন্য রসদ এবং অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহে যথেষ্ট অসুবিধা হয়। এরপর তারা আখাউড়াতে হেলিকপ্টারের সাহায্যে রসদ সরবরাহ করতে বাধ্য হয়।

 পাক বাহিনী আমাদের আজমপুর পজিশনের উপর তাদের চাপ বাড়াতে থকে। তাদের ২টা কোম্পানী একদিন সকালে আজমপুরের আধ মাইল দক্ষিণে দরগার নিকট আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণ সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যন্ত চলে। আমাদের সৈন্যরাও আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল। প্রায় ৩০ জন শত্রুসেনা হতাহতের পর তারা আক্রমণ বন্ধ করে নিয়ে আবার পশ্চাদপসরণ করে।

 বেশ কিছুদিন পর জুন মাসে পাকিস্তানী সৈন্য আবার মাধবপুরের রাস্তা এবং রেল লাইনের উপর আমার পজিশনের দিকে অগ্রসর হয়। এবার পাক সেনাদের ১২নং ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের অগ্রবর্তী দরগা পজিশন থেকে এ আক্রমণকে বেশ কয়েকদিন বিফল করে দেয়া হয় কিন্তু জুন মাসের শেষের দিকে আক্রমণ আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। পাক বাহিনী আখাউড়াতে ১২০ এম এম ভারী মর্টার এবং ১০৫ এমএম তোপ নিয়ে আসে। এসব কামানের গোলার আঘাতে এবং ১২ নং ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স-এর প্রবল চাপে আমাদের অগ্রবর্তী পজিশন সংকটময় হয়ে ওঠে এবং শত্রুদের অন্তত ৫০ জন হাতাহতের পর আমাদের পজিশন পরিত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়।

 এর পর কিছুদিন পর জুলাই মাসে পাক বাহিনী আবার আজমপুরের দিকে মুল অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আবারও তারা মাধবপুরের সড়ক ও রেল লাইনের উপর ১২ নং ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স এবং মিলিশিয়াসহ আক্রমণ চালায়। আক্রমণের পূর্বে প্রচণ্ড গোলাগুলি করতে থাকে। আমরা এ আক্রমণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে যখন পাক সেনারা সারিবদ্ধ লাইনে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন আমাদের মর্টার এবং মেনিগান তাদের অন্ততপক্ষে ১০০/১২০ জনের মত লোককে হতাহত করে। তারা আমাদের অবস্থানের কোন কোন জায়গায় ঢুকে পড়ে কিন্তু আমাদের পাল্টা আক্রমণে আমরা পাক সেনাদের হটিয়ে দিই। এ সংঘর্ষ প্রায় দুই দিন চলে। আমরাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, যেকোনো অবস্থাতেই আমরা আমাদের ঘাঁটি ছাড়বো না। শত্রুসেনাদের যথেষ্ট হতাহত হচ্ছিল প্রতিদিনই, কিন্তু তারাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আমাদের এ অবস্থানটি দখল করার জন্য। তাদের কামানের গোলায় আমাদের পজিশনটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল কিন্তু তবুও আমাদের সৈনিকরা আত্মবিশ্বাস হারায়নি। আমাদের অবস্থানটি আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের আগরতলা বিমানবন্দরের বেশ নিকটেই ছিল। এর ফলে পাকবাহিনীর কামানের গোলার স্প্লিনটার মাঝে মাঝে বিমানবন্দরে