পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১২৪

আমরা খবর পাই যে, পাকবাহিনী প্রায়ই হোমনা থানার নিকট কাঠালিয়া নদী এবং গোমতী নদীতে লঞ্চের দ্বারা পেট্রোলিং করে। এ খবর শুনে আমি হেডকোয়ার্টার থেকে ১টি প্লাটুন হাবিলদার গিয়াসুদ্দিনের নেতৃত্বে হোমনা থানাতে প্রেরণ করি। এই দলটি অনেক বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে দাউদকান্দি ৮ মাইল উত্তরে ও ও গৌরীপুর হতে সাত মাইল উত্তর পশ্চিমে চড়কমারী গ্রামের নিকট তাদের গুপ্ত ঘাটি গড়ে তোলে। হাবিলদার গিয়াসুদ্দিন চড়কমারী গ্রামের নিকট পাকসেনাদের লঞ্চকে এ্যামবুশ করার জন্য তার দলটিকে নিয়ে নদীর পাড়ে একটি অবস্থান গড়ে তোলে। পাকসেনারা নিত্যনৈমিত্তিক টহলে সকালে পশ্চিম হতে কাঠালিয়া নদী দিয়ে লঞ্চে অগ্রসর হয়। লঞ্চটি যখন ৫০ গজের ভিতর চলে আসে, তখন হাবিলদার গিয়াসুদ্দিনের পার্টি মেশিনগান, হালকা মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র হতে অতর্কিতে গোলাগুলী চালাতে থাকে। পাকসেনারা অনেকেই হতাহত হয়। লঞ্চটির সারেং লঞ্চটিকে একটা চরের দিকে নিয়ে ভিড়াবার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। এরপর অনেক পাকসেনা লঞ্চ থেকে পানিতে ঝাপ দিয়ে পড়ে কিন্তু তাতেও তারা পানিতে গুলির আঘাতে মারা যায়। লঞ্চটিও আমাদের মেশিনগানের গুলিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায় এবং বেশীর ভাগ পাকসেনা পানিতে পড়ে যায়। শুধু কয়েকজন সাতরিয়ে অন্য পাড়ে উঠে পালাতে সক্ষম হয়। এই লঞ্চে পাকসেনাদের অন্ততঃ ৭০/৮০ জন লোক ছিল এবং সঙ্গে ৩জন বেসামরিক লোকও ছিল। হাবিলদার গিয়াসুদ্দীনের লোকেরা লঞ্চ থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার করে। সেদিনই বিকেল ৫টার সময় পাকবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার তাদের এই লঞ্চটি এবং লোকজনের খবরাখবর নেয়ার জন্য ঐ এলাকায় অনেক ঘোরাফিরা করে কিন্তু কোন খোজখবর না পেয়ে হেলিকপ্টারটি ফেরত চলে যায়। এ এ্যাকশন সকালে প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলে পার্শ্ববর্তী সমস্ত এলাকার স্থানীয় লোকেরা দূর থেকে তা প্রত্যক্ষ করে। পাকবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হতে দেখে স্থানীয় লোকের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। তারা মুক্তিবাহিনীর উপর আরো আস্থাশীল হয়। হাবিলদার গিয়াসুদ্দিন এখনও এই এলাকার লোকের কাছে কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে বিরাজ করছেন।

 সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর অধীনে যে কোম্পানীটি লাকসামের দক্ষিণে নোয়াখালীর উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে পাঠানো হয়েছিল, সে কোম্পানীটি ও এ অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের কার্যকলাপ চালায়। চাঁদপুর থেকে পাকবাহিনী যে রাস্তা নোয়াখালী যাবার জন্য ব্যবহার করত, সে রাস্তায় লক্ষ্মীপুরের নিকট ৯০ ফুটের একটি সড়কসেতু বিধ্বস্ত করে দেয়। এর কিছুদিন পর পাকবাহিনী পশ্চাদপসরণ করলে সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রায়পুর থানা আক্রমণ করে। এ আক্রমণের ফলে দালাল পুলিশের সাহায্যে স্থানীয় লোকদের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করত। এ থানা দখল করে নেয়ার ফলে সমস্ত এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

 ১৬ই জুন আমাদের ২টি গেরিলা পার্টি হেডকোয়ার্টার থেকে পাঠানো হয়। ৬ জনের একটি কুমিল্লার দক্ষিনে ইলেক্ট্রিক পাইলন উড়ানের জন্য এবং আরও ৬ জনের একটি পার্টিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরে তিতাস গ্যাসলাইন কাটার জন্য পাঠানো হয়। ২১শে জুন প্রথম পার্টিটি ২টি ইলেকট্রিক পাইলন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে নোয়াখালী বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় দলটি ব্রাহ্মনবাড়িয়ার উত্তরে তালশহরে ২৪শে জুন সন্ধ্যায় তিতাস গ্যাসের ৪ ফুট পাইপ উড়িয়ে দেয়। এর ফলে তিতাস গ্যাস ঢাকা নারায়নগঞ্জ আশুগঞ্জ এবং সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনগুলিতে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে এসব পাওয়ার স্টেশনগুলি হতে বিদ্যুৎ সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এতে শিল্প এলাকাগুলির যথেষ্ট ক্ষতি হয়।

 মতিনগর থেকে একটি প্লাটুন রাজাপুর পাক অবস্থানের উপর হামলা করার জন্য পাঠানো হয়। এই প্লাটুনটি ২২শে জুন আমাদের ঘাটি থেকে রাজাপুরের দিকে অগ্রসর হয়। সন্ধ্যায় রাজাপুর শত্রুঅবস্থানটি তারা পুঙ্খানুপঙ্খরূপে রেকি করে। তারা জানতে পারে যে পাকসেনারা বেশ অসতর্কভাবে তাদের অবস্থানে আছ। ২২শে জুন ভোর ৪টায় আমাদের দলটি অতর্কিতে গোপনপথে শত্রু অবস্থানের ভিতর প্রবেশ করে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের পাকসেনারা সম্পূর্ণ হকচকিত হয়ে যায়। এই আঘাতে আমাদের লোকদের হাতে তাদের