পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৬৪

 কর্নেল রকিব নতুন ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার হিসেবে আসছেন। তিনিও ভালো লোক। আমার যা হয়েছে তার জন্য কোন আফসোস নাই। খোদা যা করেন, ভালোর জন্য করেন।

 বেলা প্রায় ১টায় বিগ্রেডিয়ার মজুমদার ব্যাটালিয়নে পৌঁছান এবং আমার সাথে এক ঘণ্টা পর্যন্ত আলাপ আলোচনা করেন। তাঁর কাছে কিছু প্রশ্ন করলে তিনি তার পুরোপুরি জবাব দিতে পারননি। আমার মনে হচ্ছিল তিনি কিছু বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু ঘোলাটে পরিস্থিতিতে মুখ খুলে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। বেলা প্রায় আড়াইটার দিকে লেঃ কর্নেল কাজী রকিব ব্যাটালিয়নে পৌঁছে যান। বেলা প্রায় তিনটায় বিগ্রেডিয়ার মজুমদার সৈনিকদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন। ভাষণের মর্ম এই ছিল যে, আমরা সৈনিক, আমরা সরকারের নির্দেশ মোতাবেক চলি। এবং সরকার যা হুকুম দেন তা আমরা পালন করতে বাধ্য হই। ব্যাটেলিয়নে ঘণ্টাখানেক এ পরিপ্রেক্ষিতে ভাষণ দেন। তারপর লেঃ কর্নেল রকিবকে ব্যাটালিয়ন-এর ভার বুঝিয়ে দেন। এবং সৈনিকদের বলেন, আজ থেকে লেঃ কর্নেল রকিব তোমাদের নতুন ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার। বেলা প্রায় পাঁচটার দিকে তিনি ঢাকা রওনা হয়ে যান। কিন্তু যাবার আগে আমি তাঁকে বলেছিলাম, স্যার আপনি আমাদের ব্যাটালিয়নে নতুন এসেছেন। তাই আজ রাতটা এখানে থেকে যান। কিন্তু তিনি বলেন যে ঢাকাতে তিনি তার শ্বশুরবাড়িতে থাকবেন। এখন আমি উপলব্দি করতে পারছি যে যদি তিনি আমাদের ব্যাটালিয়নে থাকতেন, তাহলে হয়ত আজ আমাদের সাথেই থাকতেন।

 বিগ্রেডিয়ার মজুমদার চলে যাবার পর আমি ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার রকিবকে দেশের তদানীন্তন গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের মনোভাব জ্ঞাত করাই। কিন্তু তাঁর মনোভাব সম্পূর্ণরূপে না জানাতে তাঁর সাথে খোলাখুলি আলাপ করতে পারছিলাম না- যদিও আমার পক্ষ থেকে যতদূও সম্ভব ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের মনোভাব তাঁকে জ্ঞাত করাই। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন কিভাবে মোতায়েন ছিল তাও তাঁকে বলি। ডেপ্লয়মেণ্টটা এই- এক কোম্পানী ময়মনসিংহ, এক কোম্পানী টাঙ্গাইলে- এই দুই কোম্পানীর ভার ছিল আমার উপর। এক প্লাটুন ছিল রাজেন্দ্রপুর এ্যামুনিশন ডিপোতে। সেখানে আরো তিনটি পাঞ্জাবী প্লাটুন ছিল-এক প্লাটুন পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট, এক প্লাটুন বেলুচ রেজিমেণ্ট, এবং এক প্লাটুন ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেজিমেণ্ট। ব্যাটালিয়নের বাকি লোক সব জয়দেবপুর প্যালেসে ছিল।

 ২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১০টার দিকে কর্নেল রকিবের ছেলে ঢাকা থেকে টেলিফোনে জানায় যে তাদের বাসায় কয়েকটা বেনামী টেলিফোন কল এসেছে এবং ধমক দিয়ে বলা হয়েছে যে তাদের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ঐ দিন বিগ্রেড কণ্ট্রোল রুমে আমাদের ব্যাটালিয়নের একজন পাঞ্জাবী অফিসার কর্তব্যরত ছিল। কর্নেল রকিব তাকে নির্দেশ দেন সে যেন ইপিআর হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন করে সেখান থেকে কিছু আমর্ড গার্ড তাঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তিনি ইপিআর থেকে মনে হয় এই ভরসায় সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন যে তিনি মাত্র কিছুদিন আগে ইপিআর থেকে এসেছেন। আমর্ড গার্ড তাঁর বাসায় পাঠানো হয়েছিল কিনা, তা পরে আর জানতে পারিনি।

 ২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১২টায় জেনারেল টিক্কা খান ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার কর্নেল রকিবের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন এবং বলেন যে গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে গোলযোগ চলছে। একজন দায়িত্বশীল অফিসারের নেতৃত্বে যেন সেখানে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠানো হয়। গাজীপুর জয়দেবপুর থেকে নিকটবর্তী। সেখানে কোন গোলযোগ হলে নিশ্চয়ই আমরা খবর পেতাম। কিন্তু যেহেতু টিক্কা খান নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন সেহেতু ঐ রাতেই প্রায় তিনটায় এক কোম্পানী সৈন্য একজন অফিসারের নেতৃত্বে সেখানে পাঠানো হয়। সৈন্য পাঠাবার পর সেখানে দেখা গেল কোন গণ্ডগোল ছিল না। আমার মনে হয়, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ব্যাটালিয়নের সমস্ত সৈনিককে দেশের চারিদিকে ছড়িয়ে রাখা যাতে আমরা একত্রিত হয়ে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের ২৫শে মার্চের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোন বাধা সৃষ্টি না করতে পারি।