পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৭৬

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে যে রাস্তা কুমিল্লার দিকে চলে গেছে সে রাস্তার উপর নজর রাখার ভার ছিল মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশারফের উপর। তিনি সে দায়িত্ব পালন করার জন্য উজানিসা পুলের নিকট এক কোম্পানী, গংগা সাগরে এক কোম্পানী এবং গোকনঘাটে এক কোম্পানী সৈন্য মোতায়েন করেন।

 যেহেতু আমার সুদক্ষ সৈনিকের অভাব ছিল সেহেতু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, প্রাক্তন ইপিআর, পুলিশ এবং আংশিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক লোক নিয়ে এই সমস্ত কোম্পানী পুনর্গঠন করা হয়।

 সৈন্যসংখ্যা আমাদের কম থাকায় ৪ঠা এপ্রিল থেকেই আমি আমার হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়াতে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি। ঐ ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ যুবক ট্রেনিং নিচ্ছিল। অল্প সংখ্যক অফিসার এবং ইনস্ট্রাকটর নিয়ে আমি এই ট্রেনিং শুরু করি। আমার যে সমস্ত অফিসার ছিল তাঁরা তাঁদের স্ব স্ব কোম্পানী নিয়ে ৪ঠা এপ্রিল নিম্নলিখিত জায়গাতে মোতায়েন ছিলঃ ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান নরসিংদীতে, ক্যাপ্টেন নাসিম আশুগঞ্জে, লেঃ মুরশেদ লালপুরে, ক্যাপ্টেন মতিন সরাইলে, ক্যাপ্টেন আজিজ শেরপুর কাদিপুরে, ক্যাপ্টেন এজাজ চৌধুরী চট্টগ্রাম অভিমুখে, মেজর মইন তেলিয়াপাড়াতে তার কোম্পানীর সাথে, মেজর নুরুল ইসলাম ট্রেনিং দেওয়ার জন্য এবং লেঃ ইব্রাহীম আমার হেডকোয়ার্টারে স্টাফ অফিসার হিসেবে। ৫ ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান আমার সাথে যোগ দেয়। (নুরুজ্জামান যোগ দিয়ে তার পরিবারকে আনার জন্য রায়পুরাতে চলে যায় এবং ২৬শে জুন পুনরায় যোগদান করে।)

 আমাকে সিলেট থেকে ভৈরব এবং নরসিংদী পর্যন্ত সৈনিকদের তত্ত্বাবধান করতে হত। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, জয়দেবপুর থেকে যেদিন আমরা বেরিয়ে এসেছি ঐদিন থেকে আমাদের খাওয়া- দাওয়ার ব্যাপারে কোন চিন্তা করতে হয়নি। কারণ, আমরা যখন যেখানেই ছিলাম ঐ জায়গার জনসাধারণ আমাদের খাবার ব্যবস্থা করত। তাই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোন চিন্তা করতে হয়নি। যাঁরা আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ নরসিংদীতে মিজানুর রহমান (একজন স'মিল ম্যানেজার), আশুগঞ্জে মোঃ শফিউদ্দীন, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে প্রাক্তন এমপিএ সাচ্চু মিঞা, এবং সিলেটের সাবু চৌধুরী ও মোহাম্মদ আলকাস মিঞা।

 ৪ঠা এপ্রিল আমি সিলেট অভিমুখে যাত্রা করি আমার যে কোম্পানী সৈন্য শেরপুর, শাদিপুরে পাঠিয়েছি তাদের যুদ্ধের পরিকল্পনা দেবার জন্য। মৌলভীবাজার গিয়ে মেজর (বর্তমানে কর্নেল) চিত্তরঞ্জন দত্তের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। সেখানে মেজর দত্ত এমএনএ মানিক চৌধুরী, কিছুসংখ্যক প্রাক্তন ইপিআর এবং আংশিক শিক্ষাপ্রাপ্ত বেসামরিক লোকজনকে নিয়ে এক বাহিনী গঠন করেন। আমি মৌলভীবাজারে গিয়ে তাদের কাছে আমার মনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করি। আমার সৈনিক এবং তাদের গঠিত বাহিনী নিয়ে সিলেট জেলাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য এক পরিকল্পনা গ্রহণ করি। সিলেটে তখন এক ব্যাটালিয়নেরও বেশী সৈন্য ছিল। আমার কাছে তখন আমার নিজস্ব এক কোম্পানী সৈনিক এবং কর্নেল দত্তের দ্বারা গঠিত আরো প্রায় দুই কোম্পানী সৈনিক ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাদের নিকট যে সৈন্য রয়েছে তাদের দ্বারা সিলেট শত্রুমুক্ত করতে হলে আমাদের দুই পর্যায়ে এই আক্রমণ চালাতে হবে। প্রথম পর্যায়ে সুরমা নদীর দক্ষিণাঞ্চলকে মুক্ত করা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে সুরমা নদীর উত্তরাঞ্চল যুক্ত করা।

 এই প্রথম পর্যায় সম্পন্ন করার জন্য পাকিস্তানী যত সৈনিক সুরমা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে ছিল তাদের পরাজিত করতে তিনদিক থেকে আক্রমণ শুরু করি। এক কোম্পানী শেরপুর থেকে সিলেটের দিকে প্রধান সড়ক দিয়ে সিলেট অভিমুখে অগ্রসর হয়। এক কোম্পানী ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে রেললাইন ধরে অগ্রসর হয়, আর এক কোম্পানী শেওলা করিমগঞ্জের দিক থেকে সুরমা নদীর দক্ষিণ পার হয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়।

 এপ্রিল মাসের পাঁচ তারিখে সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে এক খণ্ডযুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয় এবং তারা পলায়ন করে শালুটিকার বিমান ঘাঁটিতে একত্রিত হয়। ৫ই এপ্রিল সুরমা নদীর সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল এবং সুরমা