পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৭৮

 আমি এই দুই কোম্পানী সৈন্য প্রাক্তন ইপিআর এবং আংশিক শিক্ষাপ্রাপ্ত বেসামরিক জনগণ দ্বারা এক ব্যাটালিয়নের মত সৈন্য আবার তৈরি করি। তাদের দ্বারাই আমি পাকিস্তানী সৈনিকদের মোকাবেলা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই। এবং আজবপুর, ভৈরব, আশুগঞ্জ, লালপুর এবং গোকনঘাটে এক ব্যূহ তৈরি এবং শত্রুদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকি।

 ১১ই এপ্রিল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ভৈরব এলাকায় পাকবাহিনী হেলিকপ্টার এবং জঙ্গী বিমানের সাহায্যে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে ব্যাপকভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। আমাদের নিকট কোন বিমানবিধ্বংসী কামান ছিল না বলে এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারিনি। পাকসেনাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়াতে ১৩ই এপ্রিল আমি কিছুসংখ্যক যুবককে ট্রেনিং দিয়ে ভৈরব, আশুগঞ্জের দিকে পাঠাই যেন মেঘনা নদীর পূর্বপারের এলাকাগুলোতে আমরা বেশ শক্তিশালী থাকতে পারি। ঐ সমস্ত ছেলেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পাক বাহিনীর জংগী বিমান দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে দুজন তরুণ শহীদ হয়। এর মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একজন সৈনিক ছিলেন। তার নাম সিপাই মোহাম্মদ মোহসীন। ট্রেনিং প্রাপ্ত যে ছেলেটি শহীদ হয় তার নাম জানা নেই। ঐ দিন আমাদের অপারেশনাল কো-অর্ডিনেশনের জন্য মৌলভীবাজার যেতে হয়। আক্রমণের কথা শুনে আমি মৌলভীবাজার থেকে ১৩/১৪ই এপ্রিল রাত দুটার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওয়ানা হয়ে ভোরে প্রায় ৫টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে সেদিন কর্নেল রেজা ছিলেন। পাকবাহিনীর আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়াতে আমি সরাইলে যে রিজার্ভ কোম্পানীকে রেখেছিলাম তিনি সেই কোম্পানীকে লালপুরে আমাদের লোকদের সাহায্যার্থে পাঠান। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছে এ খবর পাই যে সরাইলে আমার যে রিজার্ভ কোম্পানী ছিল, তারা লালপুর অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেছে। অয়ারলেস সেট না থাকাতে যোগাযোগ রক্ষা করা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর হচ্ছিল। কারণ, করো সাথে কিছু বলতে হলে আমাকে রানার দ্বারা অথবা নিজে গিয়ে যোগাযোগ করতে হত। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই রিজার্ভ কোম্পানীকে ইচ্ছা থাকলেও ফিরিয়ে আনতে পারিনি। সরাইলে তাদের রাখার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে, যুদ্ধ যদি ব্যাপক আকার ধারণ করে তাহলে তারা যেন তালশহর ও গোকনঘাট এলাকায় ব্যূহ রচনা করতে পারে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শত্রুযদি মেঘনা নদীর পূর্বপারে আমরা যে ব্যূহ তৈরী করেছি সেটা ভেদ করে তা হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছার পূর্বে তাদের যেন বাধা দিতে পারি। তাছাড়া মেঘনা নদীর পুর্বপারে আমার যেসব সৈন্য মোতায়েন আছে তাদের সাহায্যে যেন তারা আসতে পারে। এই রিজার্ভ কোম্পানী লালপুরে চলে যাওয়াতে আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

 ১৪ই এপ্রিল সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলষ্টেশনে গিয়ে কিভাবে তাঁদের ফিরিয়ে আনা যায় সেই পরিকল্পনা করছিলাম। এমন সময় প্রায় সকাল সাড়ে পাঁচটায় পাক সেনাবাহিনী আমার বাহিনীর উপর ভীষণভাবে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈনিক রেল লাইন ঘেঁষে ভৈরবের দিকে অগ্রসর হয়। এক ব্যাটালিয়ন সৈনিক আইডব্লিটিএ’এলসিটি এবং মোটর লঞ্চের সাহায্যে মেঘনা নদী দিয়ে লালপুরের দিকে অগ্রসর হয়। ঠিক এই সময় নরসিংদীর নিকটবর্তী কোন এক জায়গা থেকে দূরপাল্লার কামান দ্বারা লালপুর, আশুগঞ্জ এবং ভৈরবে ভীষণভাবে গোলাবর্ষণ হচ্ছিল। শুধু তাই নয়, ছয়খানা এফ-৮৬ জঙ্গী বিমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ, ভৈরব এবং লালপুর প্রভৃতি জায়গাগুলোতে ভীষণভাবে আক্রমণ করে এবং সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে দুপুর সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ক্রমাগত ছয় ঘণ্টা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। যখন জংগী বিমানের আক্রমণ চলছিল তখন ছয়খানা হেলিকপ্টার দ্বারা কয়েকবার তারা নরসিংদী থেকে প্রায় দুই কোম্পানী কমাণ্ডার আমাদের পিছনে মেঘনার পূর্ব পারে অবতরণ করায়। যুদ্ধ তখন তুমুলভাবে বেধে যায়। এই যুদ্ধে আমাদের নিকট কোন দূরপাল্লার কামান বা ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং বিমানবিধ্বংসী কামান না থাকায় আমাদের সৈনিকদের মনোবল বেশ ভেংগে যায়। কারণ আমরা চতুর্দিক থেকে আক্রান্ত হই। এভাবে বেলা প্রায় ১২টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এবং আমার সৈনিকগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাদের একত্রিত করতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। যেহেতু আমার নিকট কোন রিজার্ভ ফোর্স ছিল না, তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার