পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৮৫

 আমার বাসা থেকে (আমার ফ্যামিলির সবই তখন ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে ২৬/২ নং তোফায়েল কলোনী, বর্তমানে আজিজ পল্লীতে) কয়েকবার টেলিফোনে কোন অজানা লোক তাদেরকে বিরক্তিপূর্ণ টেলিফোন করে উত্ত্যক্ত করছে বলে খবর আসে।

 ২৬শে মার্চ ১৯৭১ঃ ঐ দিন সকালে রেডিও'র খবর জানতে পারি যে, ঢাকা শহরে “অনির্ধারিত সময়ের জন্যে” কারফিউ দেওয়া হয়েছে, এবং বিভিন্ন মার্শাল ল' নির্দেশবলী রেডিও মারফত শুনলাম। ঐ সব খবরে আমদের নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া হলেও সমষ্টিগতভাবে প্রকাশ পাওয়া সম্ভব ছিল না, কেননা তখনও আমরা নিয়মতান্ত্রিক সৈনিক হিসাবে কাজ করে যাচ্ছিলাম। আমি অয়ারলেস সেট-এর কাছে গিয়ে দেখি যে, আমাদের সেটের ফ্রিকুয়েন্সীতে শুধুমাত্র ঢাকা কণ্ট্রোল জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ আছে। আমাদের প্রশ্নের কোন সদুত্তর অবাঙ্গালী অপারেটর দেয় না। ঐ সময় আমি ব্রিগেড কমাণ্ডারের সঙ্গে অয়ারলেস-এ কথা বলে অবস্থা আঁচ করতে চাই, কিন্তু তিনি কোন মন্তব্য না করে এড়িয়ে গেলেন এবং বললেন যে, যখন দরকার হবে তখন তোমাদেরকে কাজের জন্যে ডাকা হবে। ঐ দিন ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ সবার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সমষ্টিগতভাবে কিছু প্রকাশ পায় না। যাহোক, ঐ দিন সকালে এবং বিকালে জয়দেবপুস্থ সমস্ত অফিসার, জেসিও, এনসিও এবং সৈনিকদেরকে একত্রীভূত করে তাদেরকে সামরিক শৃঙ্খলা রাখার উপর গুরুত্ব দিই এবং বলি যে, অনেক সময় নিজেদের ব্যক্তিগত অনুভূতির ঊর্ধ্বে উঠে সামরিক ডিউটি পালন করতে হয়। ঐ দিন দুপুরের পর থেকে লোক মারফত ঢাকার ঘটনার কিছু কিছু আমাদের কানে এসে পৌঁছায়। তাছাড়া, বিবিসি এবং আকাশবাণীর খবরে আমাদের ভিতরে কিছু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এবং সেই সময় আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। এক কথায় যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ঐ দিন বিকালে কিছু অফিসার জেসিওদের সঙ্গে কথা বলার সময় বিশেষ করে সুবেদার নূরুল হক (তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর- পরে অনারারী ক্যাপ্টেন হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন-স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বীরপ্রতীক পদক পান) সংশয় প্রকাশ করেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে। আমি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি এবং ঐ দিনই সন্ধ্যায় অতর্কিত হামলার মোকাবেলা করার মত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, অর্থাৎ অবস্থান সুদৃঢ় করা, অধিকসংখ্যক প্রহরী নিয়োগ ইত্যাদি বন্দোবস্ত করি। সন্ধ্যার দিকে আমরা অয়ারলেসে খবর পাই যে, ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে এবং আরও সৈন্য পাঠিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এই অবস্থায় আমাদের দিন কাটে।

 ২৭শে মার্চ ১৯৭১ঃ ঐ দিন শেষ রাত্রে আনুমানিক ভোর তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে মেজর শফিউল্লাহ আমার কামরায় একজন এনসিও এবং একজন সিপাহীকে নিয়ে আসে, বলে যে, তারা আমাদের যে প্লাটুন রাজেন্দ্রপুর এম্যুনিশন ডিপোতে ডিউটিতে আছে সেই প্লাটুনের লোক। তাদের ভাষ্যমতে, পাকিস্তানীরা অতর্কিতভাবে আমাদের প্লাটুনের উপর ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেছে, এবং শুধুমাত্র তার দুজনই জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তাদেরকে বেশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করার পরও তাদের বক্তব্য সম্বন্ধে আমি সন্দিহান হয়ে উঠেলাম। আমি স্থির করলাম যে, ঐ ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করা প্রয়োজন। আমি সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ডকে বললাম ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন পাঠিয়ে ঐ ঘটনার তদন্ত করতে এবং সঙ্গে ঐ লোক দুটোকে পাঠাতে। তখন উপস্থিত সকলের একটু ইতস্ততঃ ভাব দেখলাম। এবং মেজর শফিউল্লাহ আমাকে বললেন যে, আমরা হয়ত পর্যবেক্ষণের ভিতরে আছি, রাত্রে বেশ প্লেন চলাচল করেছে। দিনের আলো না বেরোন পর্যন্ত কিছু 'মুভ' করলে দুর্ঘটনা হতে পারে। তখন আমি নির্দেশ দিলাম যে, ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বের প্লাটুন একটু পরে রওনা হয়ে টঙ্গী-জয়দেবপুর রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তায় গিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। আমি নিজে ফজরের নামাজের পর ঐ জায়গায় গিয়ে প্লাটুনের সঙ্গে মিলিত হবো এবং ঘটনার তদন্তে উপস্থিত থাকব। ঐ মত আমি প্লাটুন নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে সকাল ৭.৮টার দিকে পৌঁছাই। রীতি পালন করে ভিতরে গিয়ে দেখি আমাদের প্লাটুন বহাল তবিয়তে আছে এবং শুধু ঐ দুজনই কোন ভয়ে পালিয়ে গেছে। ঐখানে পাক বাহিনীর আরও দুটি প্লাটুন ডিউতে আছে। যাহোক, ওখানে যাওয়ার পরেই ঢাকার আর্মি এ্যাকশনের হিংস্রতা এবং নগ্নতা কিছু