পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২১৪

ঘটনা পুরাপুরি বলিলে তিনি আমাকে বলেন যে, তাহার ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার জয়দেবপুরে 'অয়ারলেসে আলাপ করার পর আবার আমার সঙ্গে দেখা করিবেন।

 রাত্রিতেই আমি পুলিশ, সিভিল ও আওয়ামী লীগের লোকজনের সাহায্যে আমার উইং-এর লোকেশন বদলী করিয়া রাবেয়া হাই স্কুলে নিয়া যাই, কারন আমি অনুমান করি যে পরের দিন পাক বাহিনী খবর পাইলে হয়তো কোন এয়ার এ্যাকশন নিতে পারে। সিভিল লোকদের মধ্যে যাহারা অগ্রভাগে কাজ করিয়া আমাকে সাহায্য করেন তাহাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন এম-এন-এ (বর্তমান আওয়ামীলীগের ভাইস প্রেসিডেণ্ট) জনাব রফিক উদ্দিন ভূইয়া, বর্তমানে লণ্ডনে এ্যাম্বাসেডর জনাব সৈয়দ সুলতান সাহেব, বর্তমান এমপি হাতেম আলী তালুকদার সাহেব প্রমুখ।

 পরের দিন ২৯-৩-৭১ তারিখে সকাল বেলা আমি রাবেয়া হাইস্কুলে ইপিআর-এর লোক সহ বাংলাদেশ পতাকাকে গার্ড অব অনারের সাথে সালাম দিয়া পতাকা ছুঁইয়া নতুন করিয়া শপথ নিই যে আমরণ যুদ্ধ করিব। উল্লেখযোগ্য যে, পতাকা তুলিয়াছিল হাবিলদার নিয়াজ। কারণ এখন আর গত্যন্তর নাই। অনুমান বেলা ১১টার দিকে যখন আমি খাগডহর-এর দিকে যাচ্ছিলাম নতুন বাজারের মোড়ে একজন লোক সাদা পোশাকে আমাকে পরিচয় দেয় যে তিনি বেলুচ রেজিমেণ্টের একজন বাঙ্গালী ক্যাপ্টেন এবং আমার সঙ্গে যোগ দিতে চান। কিন্তু আমি তাকে বিশ্বাস করিতে না পারায় পরে দেখা করিতে বলি, কারন আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম। একটু পরেই মেজর নূরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি বলেন যে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ময়মনসিংহের ইপিআর-এর যুদ্ধের কথা শুনিয়াছি। তাহারা বৈকালের দিকে ময়মনসিংহে পৌঁছাইতেছে যাহাতে কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসার রহিয়াছেন।

 সন্ধ্যার পর ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ময়মনসিংহের রাজবাড়িতে একত্রিত হয়। এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ লিডারসহ একটি গোপন বৈঠক করিয়া ময়মনসিংহের প্রতিরক্ষা এবং ঢাকা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি নকশী কোম্পানীকে জামালপুরের দায়িত্বে, করইতলা কোম্পানীকে সদর পশ্চিম দিকের দায়িত্বে এবং লেংগুরা কোম্পানীকে সদর দক্ষিণ দিকের দায়িত্বে দিয়া আমার হেডকোয়ার্টার কোম্পানী ও উইং হেডকোয়ার্টারসহ নরসিংদী হইয়া ঢাকার পূর্বদিক দিয়া আক্রমণ চালাইবার সিদ্ধান্ত নিই।

 ৩০-৩-৭১ তারিখে মেজর শফিউল্লাহ সকাল ৮ ঘটিকার সময় আমার ইপিআর ফোর্সের সাথে রাবেয়া হাইস্কুলে আলাপ করেন এবং তাহাদেরকে ঢাকার দিকে রওনা হওয়ার জন্য বলেন। ঐ দিন ঐ সময়ই আমি আমার নিকট ক্যাপচার করা ১৪৭০টি রাইফেল, ২৮টি এলএমজি, বহু স্টেনগান, এক লক্ষ পয়ত্রিশ হাজার ৩০৩ গুলি, ছত্রিশ হাজার ৯ এমএম গুলি ইত্যাদি তাহার নিকট হস্তান্তর করি। অন্যদিকে, বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একটি কোম্পানীর তৎকালীন ক্যাপ্টেন (বর্তমান লেঃ কর্ণেল) নাসিম সাহেবের নেতৃত্বে ট্রেনে ভৈরব হইয়া ঢাকার পথে রওনা দিই। বেলা সাড়ে বারটার সময় এই স্পেশাল ট্রেন ময়মনসিংহ স্টেশন ত্যাগ করে। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান আমাদের দলে যোগ দেন। রাত্রি প্রায় ১১টার দিকে ভৈরব পৌঁছালে ক্যাপ্টেন নাসিম সাহেব তাহার কোম্পানী সহ ভৈরব স্টেশনে নামিয়া যাইতে থাকিলে আমি তাকে বলি যে, ঢাকা যাইবেন না? তিনি উত্তরে বলেন যে, সকালবেলা একটা কোম্পানী আপনি নরসিংদীতে পাবেন। আপনি গিয়া আগের দিকে ব্যবস্থা করেন।

 আমরা সকালের দিকে নরসিংদীতে পৌঁছাইয়া সড়ক পথে ঢাকার দিকে রওনা হই। কিন্তু ডেমরা ঘাট পাক ফোর্সের দখলে জানিতে পারিয়া পাঁচ দোনা বাজার হইতে আমরা ঢাকা শহরের প্রায় ১২ মাইল দূরে ভাঙ্গা নামক স্থানে জঙ্গলে শীতালক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরে সন্ধ্যার পর অবস্থান নিই। এই ঘটনা ৩১-৩-৭১ তারিখের। এখানে আলীজান জুট মিলের ম্যানেজার জনাব মিজানুর রহমান সাহেবের নিকট হইতে আমরা খুব সাহায্য পাই।

 এদিকে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একটি কোম্পানী ক্যাপ্টেন সাইগলের নেতৃত্বে আমাদের সঙ্গে নরসিংদীতে ৩১-৩-৭১ তারিখে বেলা প্রায় দুইটার দিকে যোগ দেয়। ডেমরায় পাক ফোর্স যাহতে আমাদের ক্ষতি না করিতে