পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২২৩

 যাইহোক, আমি সিলেটকে মুক্ত করবার যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি তা আমাকে যে ভাবেই হোক পালন করতেই হবে। মনে বিশ্বাস ও স্বস্তি পেলাম যখন সবাই বলল, স্যার আমরা তৈরী। যা আছে তাই নিয়ে নরপিশাচদের বধ করব এবং সিলেটকে মুক্ত করব। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম এই সামান্য হাতিয়ার ও সৈন্য নিয়ে কিভাবে কি করে পাকিস্তানীদের শায়েস্তা করব। ঠিক করে ফেললাম জনগনের শক্তিই হল বড় শক্তি এবং তার জন্য স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাহায্য আমাকে নিতে হবে। স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাছে যা যা আছে এবং আমার কাছে যা সৈন্য আছে তাই নিয়ে আমাকে সিলেট মুক্ত করতে হবে। তাই স্থানীয় গ্রামবাসীদের ডেকে বললাম, তোমরা আমার সৈন্যদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে এবং “জয় বাংলা” ধ্বনি উঠিয়ে চারিদিকের আকাশবাতাস কাঁপিয়ে তুলবে। এই আওয়াজ শুনে শত্রুরা মনে করে যেন অনেক সৈন্য নিয়ে আমরা এদের বিরুদ্ধে লড়তে এসেছি। মানিক চৌধুরীকে আমি বললাম যেভাবে হোক অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের ব্যবস্থা করতেই হবে।

 ২৮/২৯শে মার্চ আমার সৈন্যদের সংঘবদ্ধ করলাম। দুই প্লাটুন সাতগাঁ পাহাড়ের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। শ্রীমঙ্গল থেকে হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাটে যদি শত্রুর আসতে হয় তাহলে সাতগাঁ পাহাড়ের মধ্য দিয়েই আসতে হবে। বাংরাদেশের করণ, রেললাইন ও বড় রাস্তা সাতগাঁ পাহাড়ের মধ্যে দিয়েই গেছে।

 শত্রুরা কোথায় আছে সঠিক খবর পাচ্ছিলাম না। ভাসা খবর এসে পৌঁছাচ্ছিল। শ্রীমঙ্গল থেকে লোকজন আসা প্রায় বন্ধ ছিল। সঠিক খবর বাংরাদেশেরপাবর জন্য কয়েকজনকে শ্রীমঙ্গলের আশেপাশে পাঠালাম।

 এদিকে রশীদপুর আমাদের প্রথম ক্যাম্প বানালাম। রশীদপুরের আশেপাশে -বাগান ছিল, সব বাঙ্গালী ম্যানেজাররা খুব সাহায্য করেছেন। সৈন্যদের খাওয়া-দাওয়া, থাকার ব্যবস্থা এবং ট্রেনিংয়ের জায়গা সবই তাঁরা ব্যবস্থা করেছেন। চ-বাগানের ম্যানেজার মোস্তফা, আজিজ এদের নাম করতেই হয়। মানিক চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্র গোলাবরুদ বন্দোবস্ত করতে লাগল। বাস, ট্রাক যা পাচ্ছে আমাদের সাহায্যের জন্য এক জায়গায় করছে। আমরা আছি এ খবর জেনে নানা জায়গা থেকে যাদের একটু সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল আমাদের সৈন্য দলে যোগ দিতে লাগল।

 এদিকে খবর পেলাম আমরুল -বাগানের দিকে পাকিস্তানীরা আসছে চুনারুঘাটে যাবার জন্য। ম্যাপে দেখলাম রাস্তাও একটা আছে এবং লোকজনের কাছ থেকে জানলাম এ রাস্তা দিয়ে শুধু মানুষই চলতে পারে, গাড়ী চলতে পারে না। যা কিছু সৈন্য ছিল, প্রায় দুই প্লাটুনের মত, পাঠিয়ে দিলাম আমরুল চা-বাগানের দিকে। ওরা পৌঁছার পর খরব পাঠাল যে পাকিস্তানীরা এসেছিল, আবার শ্রীমঙ্গলের দিকে চলে গেছে। আমি ওদের ফিরে আসকে বললাম, কারণ আমার উদ্দেশ্য হল যত তাড়াতাড়ি সিলেট অভিমুখে যাওয়া।

 ৩০শে মার্চ খবর পেলাম পাকিস্তানীরা শ্রীমঙ্গলে এসে অত্যাচার আরম্ভ করেছে। ৩০/৩১শে মার্চ রাতে শ্রীমঙ্গলের প্রায় দুই মাইল দূরে প্রতিরোধ গড়ে তুললাম এই উদ্দেশ্যে যে ৩১শে মার্চ সকালে আমি ম্রীমঙ্গল আক্রমণ করব।

 ৩০শে মার্চ সকালে আমি আমার চার প্লাটুনকে নিয়ে চারিদিকে শ্রীমঙ্গলে আক্রমণ করলাম। ভোর আটটায় শ্রীমঙ্গলে পৌঁছলাম। খবর পেলাম পাকিস্তনীরা শ্রীমঙ্গলে ছেড়ে মৌলভী বাজারের দিকে চলে গেছে। সময় নষ্ট না করে মৌলভীবাজার দখল করা শ্রেয় বলে মনে করলাম। চারধারে সৈন্য ছড়িয়ে পড়েছিল। ওদেরকে আবার একত্রিত করে মৌলভীবাজারের দিকে রওনা হলাম। রাস্তায় লোকজনের চলাচল এক রকম বন্ধ বললেই চলে। সৈন্যদের নিয়ে যখন মৌলভীবাজারের দিকে যাচ্ছিলাম জানতে পারলাম নয়নপুর চাবাগানে পাকিস্তানীরা আছে। পেছনে দুটো প্লাটুনকে বললাম সোজা মৌলভীবাজার রাস্তায় না এসে নয়নপুর চা-বাগান শত্রুমুক্ত করে মৌলভীবাজার আসতে। নয়নপুর চা-বাগানটা শ্রীমঙ্গল থেকে ৭/৮ মাইল দূরে। নয়নপুরের কাছে আসতেই গোলাগুলির আওয়াজ শুনলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম আমার সৈন্যরা নয়নপুরের দিকে এগুচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দুদিকের গোলাগুলির আওয়াজ শুনলাম। বেলা প্রায় আড়াইটা হবে। “জয় বাংলা” আওয়াজে পুরো নয়নপুর যেন