পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৩৯

যশোরের দেওয়া প্রত্যুত্তর আমাদের হস্তগত হয়। যশোরের প্রত্যুত্তর ছিল- “Reinforcement not possible. Try to live on your own.”

 পরদিন ৩১শে মার্চ ভোরবেলা আমাদের আক্রমণ পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। তুমুল গোলাগুলির সাহায্যে শত্রুপক্ষ আমাদের মাথা নিচু রাখতে বাধ্য করে। সারাদিনের যুদ্ধের পর আনুমানিক জীবিত শত্রুর সংখ্যা ছিল ৪০/৪৫ জন। তার মধ্যে অফিসাররা সকলেই জীবিত ছিল। গত্যন্তর না দেখে রাতের অন্ধকারে তারা দুইটি জীপ ও একটি ডজ গাড়ীতে আরোহণ করে আমাদের ব্যূহ ভেদ করে তীব্র গতিতে ঝিনইদহের দিকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। আমার সৈন্যরা সাথে সাথে তাদেরকে অনুসরণ করে। শত্রুদের ভাগ্য মন্দ। শৈলকুপার পুলের গোড়ায় আমরা গর্ত খনন করে তারপোলিন দিয়ে সেই গর্তকে ঢেকে রেখেছিলাম সেটা তারা জানত না। তাদের প্রথম ২টা জীপ উপর্যুপরি গর্তে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে। মেজর শোয়েব ও কয়েকজন শত্রুসেনারা সেখানে ভবলীলা সাঙ্গ হয়। বাকীরা আশে পাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু সজাগ মুক্তিযোদ্ধা, সেচ্ছাসেবক ও জনগণের হাত থেকে একটি শত্রুসৈন্যও বাঁচতে পারেনি। আমার নির্দেশে উৎসাহিত হয়ে তারা এক একজনকে হত্যা করে তাদের হাতিয়ার এনে আমার সদর দপ্তরে জমা দেয়। এমনও হয়েছে একটি ছেলে একটা এখন শটগান দিয়ে একজন এলএমজিধারী শত্রুসৈন্যকে হত্যা করে তার হাতের একটি আঙ্গুল ও এলএমজি আমার সদর দপ্তরে জমা করে। এই ছেলেটির বয়স ছিল ১৮/২০ বছর। নাম তার সুলতান আলী জোয়ারদার। যুদ্ধের প্রচণ্ডতা ও হৈ-হুল্লোড়ে এই ছেলেটির সাথে দেখা করা আর আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

 সেই রাত্রেই লেঃ আতাউল্লাহ শাহ ধরা পড়ে। তাকে ঝিনাইদহে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ২রা এপ্রিল বিকেলের দিকে আমর সদর দপ্তরে আনা হয়।

 ১লা এপ্রিল কুষ্টিয়া সম্পূর্ণরূপে আমাদের হাতে মুক্ত হয়। এরপর সামান্যসংখ্যক সৈন্য কুষ্টিয়ায় রেখে বাকী সৈন্যদের আমি ঝিনাইদহের দিকে পাঠিয়ে দেই। কিছু সংখ্যক সৈন্য মাগুরা, কিছুসংখ্যক ঝিনাইদহের দক্ষিণে বিশাখালী ও কিছুসংখ্যক সৈন্য কোটচাঁদপুরে অবস্থান করে। উদ্দেশ্য-যশোর থেকে উত্তর দিকে শত্রুদের অগ্রসর হবার সব পথ অবরোধ করে রাখা।

 এদিকে ২৮শে মার্চ তারিখেই কলিকাতা হয়ে বহির্বিশ্বের সাথে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। আমার মনে আছে টেলিফোনে আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক পালাক্রমে কলিকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কাছে যুদ্ধের খবর সরবরাহ করতাম।

 এক রাত্রের কথা আমি ভুলব না। সেদিন বোধ হয় ২৮ কি ২৯ তারিখ রাত্রের ঘটনা। ঢাকা থেকে খবর পেলাম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট উপাধিধারী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিজ নিজ ঘরে পাক সেনাবাহিনী অত্যান্ত ঘৃণ্যতমভাবে হত্যা করেছে। কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকাকে টেলিফোনে এ খবর দিতে দিতে আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম। সেদিন তাদেরকে এও বলেছিলাম যে, আমরাও এর প্রতিশোধ সমভাবেই গ্রহণ করব। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গার অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথা জনাব ইউনুস ইলী এম-পি-এ, ব্যারিস্টার বাদল রশীদ, প্রিন্সিপাল ফুলে হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার সাইফ উদ্দিন ও আরো অন্যান্যকে নানা বেসামরিক সংযোগ, অভ্যর্থনা, সাহায্য গ্রহণ ইত্যাদি কাজকর্মে নিযুক্ত করা হয়েছিল। স্থানীয় জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজ প্রত্যেকেই আপন আপন সামর্থ্য ও সাধ্যানুযায়ী এই যুদ্ধের আয়োজন ও সরঞ্জামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দিনাত সাহায্য করেছি।

 বিদ্রোহ করার অব্যবহিত পরে বর্তমান বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সাথে সংযোগ হওয়ার সাথে সাথেই আমার স্ত্রীকে সেখানকার কোন নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, বেশ পরে অনেক সুহৃদই এই প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী ও মেয়েরা আমরা সাথে যুদ্ধক্ষেত্রেই হাসিমুখে যেকোন পরিস্থিতেতেই থাকবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, তাই আর যাওয়া হল না। থাকল ওরা আমারই ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টারের একটি কামরায়। সেখানে থেকেই