পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৪৪

বাঙ্গালী অফিসারও সেখানে আছে। ঐদিনই আমি আমার কাছে উপস্থিত হবার জন্য লেঃ হাফিজকে লোক মারফত চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিলাম, কিন্তু হাফিজ আসেনি। ৪ঠা এপ্রিল তাই ঝিনাইদহের কমাণ্ডার মিঃ মাহবুবকে লেঃ হাফিজের খোঁজে পাঠাই। লেঃ হাফিজ তার ২/৩ জন লোক সাথে করে মাহবুবের গাড়ী করে আমার কাছে উপস্থিত হয়। তার কাছে প্রথম বঙ্গ শার্দুলদের করুণ কাহিনী বিস্তারিত জানতে পারলাম এবং আমার খবর পাওয়া সত্ত্বেও আমার সাথে দেখা না করার একটা কারণ খুঁজে পেলাম। যাই হোক, আমার পরিষ্কার মনে আছে যে আমার অধীনস্থ উপিআর বাহিনীর জামা-কাপড়, ইউনিফর্ম, বুট, ইকুইপমেণ্ট এবং কুষ্টিয়া থেকে অধিকৃত ভারী ও হালকা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং গাড়ী দিয়ে ওদেরকে সজ্জিত করে চৌগাছা এলাকায় সন্নিবেশিত করলাম।

 পূর্বেই বলেছি যে বিশাখালী (ঝিনাইদহ থেকে ৩ মাইল দক্ষিণে) যুদ্ধের পর আমার সৈন্যদের ডিফেন্স লাইনকে অগ্রগামী করে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে মাত্র ৫ মাইল দূরে রেখেছি। তার করণ ছিল এই যে, ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে আমার অবস্থান তাদের দূরপাল্লার কামানের আওতার বাইরে রাখা। দ্বিতীয়ত আমার কোন ভারী অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তে মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেবের প্রতিশ্রুত ভারী অস্ত্রাদির অপেক্ষায় থাকা ও একইসঙ্গে ক্যাণ্টনমেণ্টের উপর চাপ সৃষ্টি করে রাখা। পরিকল্পনা ছিল, ভারত থেকে কিছু পরিমাণ ভারী অস্ত্রাদি পেলেই আমরা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট আক্রমণ করব। এদিকে ঐ অস্ত্র আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বুঝতে পেরেছিলাম যে প্রতিদিনই পরিস্থিতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনুকূলে চলে যাচ্ছে, কারণ জল ও আকাশ পথে তাদের রি-ইনফোর্সমেণ্ট পুরোদমেই চলছিল। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত অফিসারের কাছে প্রতি পলে পলে সিচুয়েশন রিপোর্ট দিয়েও শুধু আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাইনি। অবশ্য এটা যে শুধু আশ্বাসই ছিল তখন তা বুঝতে পারিনি। এভাবে কেটে গেল ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১ সন।

॥ গোয়ালন্দে প্রতিরোধ ॥

 ১২ এপ্রিল খবর আসল যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা বিরাট অংশ আরিচা থেকে জলপথে গোয়ালন্দের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বুঝতে পারলাম এদেরকে যদি গোয়ালন্দে নামতে দেয়া হয়, তাহলে আমার যশোর পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। আমার ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী থেকে কোনরকমে এক প্লাটুন সেন্য ২টি এলএমজি, ১টা এমজি ও একটা ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ছোট কামান সহকারে পাঠিয়ে দিলাম নায়েক সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে গোয়ালন্দে। তাদের উপরে আমার নির্দেশ ছিল যে, পাকসেনারা যেন কোনমতেই পদ্মার এপারে অবতরণ করতে না পারে। ১৩ই এপ্রিল এই অগ্রগামী সৈন্যের সাথে পদ্মার পারে আমার ক্ষুদ্র সেনাদলের এক তীব্র সংঘর্ষ হয়। এতে পাকবাহিনীর একটি জাহাজ ডুবে যায় এবং তারা উত্তরাভিমুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরে খবর পেলাম যে পাকবাহিনী একই সময়ে নগরবাড়ীতে অবতরণ করার চেষ্টা করছে। বুঝতে পারলাম নগরবাড়ীতে যদি পাকবাহিনী বিনা বাধায় নামতে পারে, তাহলে তারা পাবনা-ঈশ্বরদী হয়ে আমার পেছন দিক থেকে আক্রমণ চালাতে পারে। তাতে আমার পজিশন অত্যন্ত সংকটময় হয়ে যাবে। তাই রাজশাহীতে যুদ্ধরত মেজর মরহুম নজমুল হককে টেলিফোন করে নগরবাড়ীতে এক কোম্পানী সৈন্য জরুরী ভিত্তিতে পাঠাবার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি যদিও এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়েছিলেন, তারা সময়মত পৌঁছতে পারেনি।

 এদিকে শুনতে পেলাম তদানীন্তন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন খোন্দকার নজমুল হকের নেতৃত্বাধীন এক কোম্পানী পরিমাণ মুজাহিদ ছিল নগরবাড়ী রক্ষণাবেক্ষণে লিপ্ত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২/৪টা গোলা নগরবাড়ীতে পড়বার সাথে সাথেই তারা সব পালিয়ে যায় এবং পাকবাহিনী ১৫ই এপ্রিল পুরাপুরিভাবে নগরবাড়ীতে অবতরণ করতে সক্ষম হয়। অবতরণের পর পরই পাকসেনারা তীব্র গতিতে পাবনার দিকে অগ্রসর হয়। ১৬ই এপ্রিল ভেড়ামারায় অবস্থিত আমার ক্ষুদ্র সেনাদলের সাথে প্রচণ্ড গোলাগুলির পর পাকবাহিনী ভেড়ামারায় অবতরণ করে। ভেড়ামারার কমাণ্ডে তখন ছিল সুবেদার মেজর মুজাফ্ফর। উপায়ান্তর না দেখে সে তার সৈন্যদল নিয়ে পিছু হটে যায়।