পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড

 সৈন্য বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করার পূর্বে কতকগুলো দিক চিন্তা করতে হয়, যেমন- সৈন্যদের থাকা, খাওয়া, বেতন, যানবাহন, যোগাযোগ ইত্যাদি। তাছাড়া ডাটা, ম্যাপ ইত্যাদি করতে হয়। পঁচিশে মার্চের গণহত্যা যদি হঠাত্ব হতো তাহলে পাকিস্তানী সৈন্যগণ ২৫ শে মার্চে বাংলাদেশে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একই সাথে একই সময়ে বাঙ্গালী সৈন্য, ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার, তথা জনসাধারণের উপর আক্রমণ ও গণহত্যা চালায় কিভাবে? এতেই প্রমাণ হয় যে পাকিস্তান সামরিক সরকারের পূর্ব পরিকল্পনা নিশ্চয়ই ছিল।

 ১৫ই মার্চ, ৭১-এ প্রেসিডেণ্ট জেঃ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গের সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা, ক্ষমতা হস্তান্তর, অসহযোগ আন্দেলন প্রভৃতি সম্পর্কে প্রেসিডেণ্ট হাউসে (বর্তমান গণভবন) এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সভায় আলোচনা করেন। অপরদিকে রাতের অন্ধকারে ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে উপরোল্লিখিত জেনারেলদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্র চলত।

 যেহেতু আর্মি ইনটেলিজেন্সে-এ ছিলাম ও সাধারণ পোশাকে কর্তব্য পালন এবং চলাফেরা করতাম, সেজন্যই আমি পাকিস্তান সামরিক সরকারের কার্যকলাপ অনুসরণ করতে পারি।

 ২৫শে মার্চের পূর্বেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যে সমস্ত উচ্চপদস্থ বাঙ্গালী অফিসার ছিলেন, তাঁদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসারসহ কিছু বাঙ্গালী সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠায়। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাঞ্জাবী সৈন্যদের সঙ্গে যে সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্য ছিলেন তাঁদেরকে নিরস্ত্র করা হয়। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সকল সৈন্যকে সীমান্ত এলাকায় প্রেরণ করে ভারতের হুমকির অজুহাতে।

 যে সকল বাঙ্গালী অফিসারকে স্ব স্ব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ও কয়েকজনকে অন্য পদে দেওয়া হয়, তাদের পরিচয় যথাক্রমেঃ (১) মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফ, চীফ অব জেনারেল স্টাফ, বাংলাদেশ আর্মি। তিনি ছিলেন ৫৭-ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের (ঢাকা) ব্রিগেড মেজর (ব্রিগেড মেজরের কাজ হচ্ছে ব্রিগেডের অপারেশন প্লান করা এবং পরিচালনা করা)। মেজর খালেদ মোশাররফকে পাঠায় কুমিল্লা ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টে এবং তদস্থলে একজন পাঞ্জাবী অফিসারকে নিয়োগ করে।

 (২) ব্রিগেডিয়ার মজুমদার। তিনি চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের কমাণ্ডাণ্ট ছিলেন। তাঁকে ২২শে মার্চ ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে নিয়ে আসা হয় এবং গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। ক্যাপ্টেন চৌধুরী (বর্তমানে মেজর) বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ড'র।

 (৩) লেঃ কঃ মাসুদুল হাসান খান। তিনি ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টে জয়দেবপুরে ছিলেন। তাঁকে ২২শে অথবা ২৩শে মার্চ ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে নিয়ে আসে এবং তাকেও গৃহবন্দী করে এবং তাঁর স্থলে লেঃ কঃ রকিবকে জয়দেবপুর ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টে পাঠায়। কারণ লেঃ কঃ রকিব ৩২-পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের কমাণ্ডার ছিলেন। ৩২-পাঞ্জাব রেজিমেণ্টে কঃ তাজ মোহাম্মদকে নিয়োগ করে। ৩২-পাঞ্জাব রেজিমেণ্টেই ঢাকায় ২৫শে মার্চের রাতে গণহত্যা চালায়। এছাড়াও কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসারকে ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকায় রাখা হয়। তাদেরকে বাইরের যোগাযোগ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা হয়।

 বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে কয়েকটি ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করা। যেমন, প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে যশোর ক্যাস্টনমেণ্ট থেকে চৌগাছা (সীমান্ত এলাকা) পাঠায়। ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে জয়দেবপুর থেকে তাঁদেরকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এক কোম্পানী পাঠায় টাঙ্গাইল। উক্ত কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিলেন মেজর শফিউল্লা (বর্তমানে লিগেডিয়াল চীফ অব বাংলাদেশ আর্মি)। অন্য একটি কোম্পানী পাঠায় ময়মনসিংহে। উক্ত কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিলেন নুরুল ইসলাম (বর্তনামে লেঃ কর্নেল)।