পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৪৬

 এখানে একটা কথা বলে রাখা আবশ্যক যে, ১৬ই এপ্রিলে যখন দেখতে পেলাম সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে নিতে হবে, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তখনই নির্দেশ দিলাম সমস্ত স্থানীয় ও দূরবর্তী ব্যাঙ্কের টাকা-পয়সা, সোনা-গয়না, সাথে নিয়ে নেয়ার জন্যে। নির্দেশ অনুযায়ী ডাঃ আসহাবুল হক, ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহি, ক্যাপ্টেন মাহবুব এবং আরও কয়েকজন গণ্যমান্য লোকের প্রচেষ্ঠায় আনুমানিক সাড়ে চার কোটি টাকা ও আধ মণ সোনা আমরা সাথে নিয়ে যাই। স্থানীয় যত গুদামে চাউর ও আটা ছিল সবগুলো আমাদের গাড়ীতে উঠিয়ে নেই।

 ১৮ই এপ্রিল সকাল বেলা ঐ সীমান্তে ক্যাপ্টেন আজমের নেতৃত্বাধীনে এক কোম্পানী সৈন্য রেখে বাকী ও সদর দপ্তর নিয়ে আমি চলে যাই বেনাপোলে এবং সেখানে স্থাপন করি আমার সদর দপ্তর। ঐ দিনই আমি বেনাপোল ও যশোর রোড এবং তার দক্ষিণাঞ্চলের কর্তৃত্বভার প্রত্যক্ষভাবে নিজের অধীনে নিয়ে বেনাপোল থেকে পূর্বদিকে কাগজপুকুর এলাকায় আমার প্রতিরক্ষা ব্যূহ গঠন করি। ২০শে এপ্রিল সকাল ১০টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত সেনাপতি কর্নেল এম, এ, জি. ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) বেনাপোল আমার সদর দপ্তর পরিদর্শনে আসেন। বেনাপোলে তাকে যথাযথভাবে সামরিক সালাম দেওয়া হয়। আমি সেনাপতিকে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিই এবং আমার সামরিক সরঞ্জামাদি অভাব সম্বন্ধে তাকে অবগত করাই।

 বেনাপোল থেকে পূর্বদিকে কাগজপুকুর এলাকায় আমার প্রতিরক্ষাব্যূহ স্থাপন করি বটে কিন্তু প্রথাগত প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্রশস্ত্র এবং সাজ-সরঞ্জামাদি যে আমার ছিল না, তা পূর্বেই বলেছি। এই প্রতিরক্ষাব্যূহের সবচেয়ে মারাত্মক দূর্বলতা ছিল যে প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের সাপোর্টিং অস্ত্রশস্ত্র ছিল না এবং ফিল্ড অয়ারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন এবং ডিগিং যন্ত্রপাতির মারাত্মক অভাব। এতসত্ত্বেও ২টি কোম্পানী ইপিআর সৈন্যনিয়ে আমি এই প্রতিরক্ষাব্যূহ যতাযথ সম্ভব পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। আমার কছে মাত্র ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও কিছুসংখ্যক গোলা ছিল, সেগুলো আমি রিজার্ভে রেখেছিলাম স্থান ও কালভেদে প্রয়োজনমত ব্যবহার করার আশায়। এই প্রতিরক্ষাব্যূহে আমার সাথে ক্যাপ্টেন তৌফিক, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন (বর্তমান মেজর) ও ডাঃ আসহাবুল হক উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান (বর্তমান মেজর) ১০ই এপ্রিল ঢাকা থেকে পালিয়ে এসে আমার সাথে যোগদান করেন। প্রথম বঙ্গশার্দূল থেকে পালিয়ে আসা ১৫০জন সৈন্য নিয়ে হাফিজকেও বেনাপোল কাস্টম কলোনীর দক্ষিণ ভাগে রিজার্ভ বাহিনী হিসাবে পজিশন নেবার জন্য নির্দেশ দিই।

 ২৩শে এপ্রিল সকাল ১০টায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় তাজউদ্দিন আমার সদর দপ্তর বেনাপোলে এসে উপস্থিত হন বাংলার মাটিতে বৃটিশ এম-পি মিঃ ডগলাস ম্যানকে স্বাগত জানানোর জন্য। দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বৃটিশ অতিথি আমার সদর দপ্তরে এসে মাননীয় তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে ১ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা করেন। সুখের বিষয় এই যে, বৃটিশ এম-পি ভারত থেকে এসে বাংলায় পদার্পন করার সাথে সাথেই আমার সদর দপ্তরে উড্ডয়নরত বাংলার জাতীয় পতাকা দেখতে পান ও তার পতপত আওয়াজ শুনে অনেকটা আশ্বস্ত হন আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সম্ভাবনায়। মাননীয় অতিথি বিদায় নেবার ১ ঘণ্টা পরে জনাব তাজউদ্দিন মুজিবনগরে চলে যান। তিনি বিদায় নেবার ঠিক ১৫ মিনিটের মধ্যে ২৩শে এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৩ টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের উপর আঘাত হেনে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ কাগজপুকুর থেকে বেনাপোলের পূর্ব সীমানা পর্যন্ত সঙ্কুচিত করতে বাধ্য করে। যাই হোক রাতারাতি আবার আমরা নতুন করে প্রতিরক্ষা পজিশন সংগঠিতকরে নিই।

 ২৪ শে এপ্রিল ভোর ৪টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২ ব্যাটালিয়ন সৈন্য সহকারে আমাদের পজিশন আক্রমণ করে। আমার বাম দিকের কোম্পানী পজিশনে প্রথম আক্রমণ করা হয়। ২ কোম্পানীন মধ্যে যোগাযোগের জন্য রানার ব্যতিরেকে আমার আর কোন ব্যবস্থা ছিল না। অন্ধকারে এই কোম্পানীর সাথে তুমুল যুদ্ধ চলে। ভোর