পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৫৮

 চতুর্দিকে শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আমাদের সংগঠনও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। প্রত্যেকটি ঘাঁটি থেকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়ে আমরা ছত্রভংগ হয়ে পড়ি। আস্তে আস্তে ঝিনাইদহ আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। শত্রুসৈন্য কুষ্টিয়াও দখল করে ফেলে এবং চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। আমরা এই শত্রুর আক্রমণের মুখে পুনর্গঠন এবং পুনর্বিন্যাসের সময় এবং সুযোগ পাচ্ছিলাম না। চতুর্দিকে প্রচুর বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সাধারণ জনগণের মনোবলও ভেঙ্গে পড়তে থাকে। চুয়াডাংগা যখন শত্রুর আক্রমণের আওতায় চলে আসে তখন আমরা সদর দফতর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে পেছনে মেহেরপুরে নিই।

 প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টঃ প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট যশোর সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেল জলিল প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ডিং অফিসার ছিলেন। ২৫শে মার্চের আগেই প্রথম বেঙ্গলকে এক্সারসাইজের জন্য ঝিকরগাছার দিকে পাঠানো হয়। আমরা প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। আমি, মাহাবুব এবং মেজর ওসমান চিঠির মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ কর্মসূচী সম্বন্ধে তাকে অবহিত করি স্বতন্ত্রভাবে চিঠির মাধ্যমে। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার 'আহবান জানাই। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কোন চিঠিরই জবাব পাইনি। এ পরপরই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট যশোর সেনানিবাসে ফিরে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে একজন তরুণ বাঙ্গালী লেফটেন্যাণ্ট আনোয়ার শাহাদাত বরণ করেন। প্রচুর বাঙ্গালী সৈন্য হতাহত হয়। এই সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ প্রায় ৩০০ বাঙ্গালী সৈন্যকে নিয়ে চৌগাছার দিকে অগ্রসর হয়। প্রত্যেকে অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।

 ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় চুয়াডাঙায়। সে তখন প্রথম বেঙ্গলের বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন লোকদের নিয়ে চৌগাছায় একত্রিত করছিল। আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধের কিছু খবর পেয়ে সে আমাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চুয়াডাঙ্গায় আসে। তার কাছে আমি জানতে পারি যে তারা তখন ভারত সরকারের কাছে অস্ত্রশস্ত্রের জন্য চেষ্টা করছিল। আমরা তখন যৌথভাবে সামরিক পরিকল্পনার প্রস্তুতি নিতে থাকি।

 প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনঃ এই সময় আমরা জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখি। এবং আমরা আশা করছিলাম যে, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং ঘোষণা করা হবে। এই সময় আমাদের মুক্তাঞ্চলে প্রতিদিন অনেক বিদেশী সাংবাদিক এবং টেলিভিশন দল আমাদের মুক্তাঞ্চল ঘুরেফিরে দেখছিলেন এবং এত প্রতিকূল অবস্থার ভেতরেও আমরা যে শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে প্রতিরক্ষা করছিলাম তা নয়, আমরা এ রকম একটা সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান চালিয়ে জয়ী হয়েছিলাম। এই সামরিক বিজয় জনগণের উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা ও দৃঢ় সংকল্প তাদের সবাইকে বিমোহিত করেছিল।

 মেহেরপুরের কোন এক স্থানে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের প্রস্তাবের কথা আমরা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে জানতে পারি। আমরা চূড়ান্ত সিন্ধান্তের জন্য গভীর আগ্রহে প্রতিক্ষা করতে লাগলাম। এই সময় যশোরের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের প্রতিরক্ষাবূহ্য ভেদ করে এগিয়ে আসছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আমরা পশ্চাদপসরণ শুরু করি। ওদের সৈন্যসংখ্য আমাদের তুলনায় অনেক বেশী। আমাদের রণকৌশলগত পশ্চাদপসরণ ছিল প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধে অনিবার্য পরাজয়ের সূচনা মাত্র।

 ১২ই এপ্রিল- দিনের পর দিন মরণপণ যুদ্ধের পরও আমরা যখন কোন স্বীকৃতি পাচ্ছি না, তখন আমাদের মনোবল ভাঙ্গতে শুরু করে। একটা পর্যায় পর্যন্ত মানুষের মনোবল অক্ষুণ্ণ থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকগুলি ব্যর্থতা আমাদের যোদ্ধাদের মনেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিল। এমন এক সংকটজনক দিনে আমরা খবর পেলাম, বাংলাদেশ সরকার ১৬ই কিংবা ১৭ই এপ্রিল শপথ গ্রহণ করবেন। তার আগেই আমি প্রাথমিক ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম। তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে আমাদের স্থান নির্ধারনের কাজ শুরু হয়েছে - শহর থেকে দূরত্ব