পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৭০

৩১শে মার্চ তারিখে শহর থেকে চার মাইল দূরে যশোর-মাগুরা রোডের ধারে হালিমপুর গ্রমে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং সেণ্টার খোলা হয়। ইপি-আর বাহিনীর জওয়ানদের নেতৃত্বে এই ট্রেনিংদানের কাজ চলবে। শোনা যায়, জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা প্রায় পাঁচশ কয়েদী স্বেচ্ছায় এই ট্রেনিং সেণ্টারে যোগ দিয়েছিল।

 কিন্তু প্রতিরোধ সংগ্রামের সমরসজ্জা শুধু যশোর শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল না প্রায় একই সাথে মহকুমা শহরগুলিতেও প্রতিরোধের প্রস্তুতি চলছিল। নড়াইলের এসডিও এবং সেখানকার বিশিষ্ট নাগরিকদের উদ্যোগে এক শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। যশোর শহরে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে, এই খবর পেয়ে তারা শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য যশোর শহরের দিকে মার্চ করে এগিয়ে চলল। নড়াইল মহকুমার হাজার হাজার লোক যার হাতে যা ছিল তাই নিয়ে এই যুদ্ধ মিছিলে যোগ দেয়। যশোর-নড়াইল রোডের দু'ধারের গ্রামগুলি তাদের ঘন ঘন জয়ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠতে লাগল।

 নড়াইল মহকুমার লোহাগড়া অঞ্চলেও একটি শক্তিআলী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নৌ-বিভাগের প্রাক্তন অফিসার শামসুল আলমের উদ্যোগে এই শাক্তশালী মুক্তিবাহিনীটি গড়ে উঠেছিল। শামসুল আলম সামরিক চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর একটা ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে আর দশজনের মতই সংসার জীবনযাপন করে চলছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার আহবানে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি তার চাকরির মায়া ছেড়ে দিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দেখতে দেখতে তার নেতৃত্বে প্রায় পাঁচশত যোদ্ধার এক মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠল। এই মুক্তিবাহিনীর জন্য থানা থেকে ও বিভন্ন লোকের কাছে থেকে দু'শর উপরে রাইফেল ও বন্দুক সংগ্রহ করা হয়েছিল।

 যশোর শহরের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোহাগড়ার এই মুক্তিবাহিনীও যশোরের দিকে দ্রুত মার্চ করে চলল। শামসুল আলম নিজ হাতে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তৈরী করে তুলেছিলেন। এখানেও হাজার হাজার লোক তাদের যুদ্ধ-যাত্রার সাথী হয়েছিল। তারা তাদের ভীমগর্জনে পথঘাট মুখরিত করতে করতে যুদ্ধের উন্মাদনায় উন্মুক্ত হয়ে ছুটে চলেছিল।

 এই যুদ্ধ-মিছিল সম্পর্কে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগারজন মেয়ে নিয়ে গঠিত একটি নারীবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অংশ হিসেবে এই যুদ্ধ-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল। এরা সবাই কলেজ ও স্কুলের ছাত্রী। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের জন্য রান্না করা এবং যুদ্ধের সময় আহতদের সেবা শুশ্রূষা করা, এটাই ছিল তাদের কাজ। এই এগারটি বীরকন্যা মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে যশোরে গিয়েছিল।

 মাগুরা ও ঝিনাইদহ মহকুমায় যাঁরা মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন এবং মুক্তি সংগ্রাম পরিচালিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একটি লোকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। তিনি হচ্ছেন মাগুরার তরুণ এসডিও ওয়ালীউল ইসলাম। এই ব্যাপক অঞ্চলের প্রতিরোধ সংগ্রাম কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

 ১লা এপ্রিল থেকে ৩রা এপ্রিল, এই তিনটা দিন হাজার হাজার পাকসৈন্য খাঁচার পাখির মত ক্যাণ্টনমেণ্টের মধ্যে অরুদ্ধ হয়ে রইল। ইতিপূর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বারকয়েক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ওরা একেবারে ঘর নিয়েছে, বেরোবার নামটি করে না।

 সৈন্যসংখ্যার দিক দিয়ে এবং আধুনিক অস্ত্রসজ্জার দিক দিয়ে শক্তি ওদের প্রচণ্ড। তাহলেও মুক্তিযোদ্ধাদের মরিয়া আক্রমণে, আর তাদের চেয়েও বেশী হাজার হাজার ক্ষিপ্ত জনতার ভীমগর্জনে ওরা যেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে ওদের মনোবল হারিয়ে ফেলেছে।