পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: নবম খণ্ড

মেজর মনোয়ার হোসেনের নিকট তার তুলে নেওয়া ফটো ও দি পিপল পত্রিকায় প্রকাশিত ফটো ছিল। আমাদের কথা শুনে শাহেদ নসরুল্লাহর পিতা খুবই চিন্তায় পড়েন। কিছুক্ষণ পর আমরা মুস্তাফিজুর রহমানের ভাই ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দেয়ার জন্য মোহাম্মদপুরে যাই। তাদেরকেও আমরা বিস্তারিত খবর জানাই এবং সতর্ক হওয়ার জন্য অন্যান্য বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনকে খবর পৌঁছাতে বলি। সেখান থেকে আমরা ক্যাণ্টনমেণ্টে ফিরে আসার পথে ফার্মগেট ছাত্রদের একটা বিরাট মিছিলের মাঝে পড়ি। ছাত্ররা ফার্মগেটে প্রতিবন্ধকতা (ব্যারিকেড) সৃষ্টি করেছিল যেন শহরে সৈন্যবাহিনীর যে সমস্ত গাড়ী গিয়েছে তারা ক্যাণ্টনমেণ্টে ফিরে আসতে না পারে। আমরা যখন মিছিলের মাঝে পড়ি তখন কয়েকজন ছাত্র আমাদের পরিচয় জানতে চায়। আমি সেনাবাহিনীর পরিচয় না দিয়ে বাঙ্গালী ও সাধারন মানুষ, গুলশানে বাসা আছে বলে জানাই। তখন তারা আমাদের গাড়ী চলার জন্য একটু জায়গা পরিষ্কার করে দেয় (তখন রাত প্রায় এগারটা)। ব্যারিকেড অতিক্রম করার পরই আমরা দেখলাম সেনাবাহিনীর ৪ খানা মেশিনগান লাগানো গাড়ী (বাতি নিভানো) কয়েকজন সৈন্য ফার্মগেটের দিকে ঠেলে নিচ্ছে। আমাদের গাড়ী একটু থামালাম। গাড়ী কয়েকখানা ফার্মগেটের কাছাকাছি গিয়েই ছাত্রদের উপর গুলি চালাতে শুরু করে। ফলে সঙ্গে সঙ্গে বেশকিছু ছাত্র ও সধারণ মানুষ সেখানেই মারা যায়। তারপর আমরা ক্যাণ্টনমেণ্টে আমাদের মেসে ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পর আমি আমাদের চট্টগ্রামের বাসায় আমার পিতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি এবং জানতে পারি যে চট্টগ্রামেও পশ্চিমা সৈন্যরা শহরে নিরীহ জনসাধারণের উপর নির্মমভাবে গুলি করছে এবং হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে। আমার পিতার সঙ্গে কথা শেষ করেই আমি ঢাকায় ধানমণ্ডিতে আমার মামা এডভোকেট জনাব আবু তাহের চৌধুরীকে টেলিফোন করি তাঁকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার খবর জানাই। রাত বারটা পর্যন্ত টেলিফোন যোগাযোগ ছিল, তার পরই আমাদের কানে অসংখ্য গুলির আওয়াজ আসে। মীরপুর, গুলশান ও এয়ার্পোট এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলির আওয়াজ ও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখি। এসময় পুরোদমে পাঞ্জাবীরা ঢাকায় নিরীহ ঘুমন্ত জনসাধারণের উপর আক্রমণ করে মেশিনগান দিয়ে নির্মমভাবে গণহত্যা শুরু করেছে। এভাবে সারারাত গণহত্যা চালায়। শেষরাতে সেনাবাহিনী ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ট্যাঙ্ক নিয়ে শহরে আক্রমণ চালায় এবং অসংখ্য বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ পাই। এভাবে আমি, ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট মুস্তাফিজ, ক্যাপ্টেন এনামসহ আরো কয়েকজন সারারাত চিন্তিত থাকি ও অনিদ্রায় রাত কাটাই।

 আমাদের বিল্ডিং-এ পাঞ্জাবী মেজর পীর কমরউদ্দিন (জি-এইচ-কিউ ফিল্ড ইনটেলিজেন্স ইউনিটের অফিসার কমাণ্ডিং ছিলেন) সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাঁর বিছানাপত্রসহ সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বলেন, তিনি অফিসে যাচ্ছেন এবং অফিসেই থাকবেন। মেজর কমর পাঞ্জাবী হলেও আমার একজন বিশিষ্ট বন্ধু এবং একই সাথে ইনটেলিজেন্স কোর্স করি। আমার আত্মীয়স্বজনের অনেকেই তাকে চিনতেন। তিনি চলে যাবার সময় অকথ্য ভাষায় আমাদেরকে কতগুলি কটুক্তি করেন ও আওয়ামী লীগকে গালিগালাজ করেন। আমাদেরকে সন্দেহ করে কিংবা ভয় করেই হয়তবা তিনি চলে যান। তাঁর এরূপ কটুক্তি ও গালাগালিতে আমরা সবাই ধারণা করি যে অন্যান্য পাঞ্জাবী অফিসারও বোধ হয় বাঙ্গালী অফিসার ও সৈন্যদের সঙ্গে অনুরূপ দুর্ব্যবহার করছে।

 ২৬শে মার্চ সকাল সাড়ে সাতটায় আমি আমার অফিসে যাই। সেখানে মেজর মনোয়ার হোসেনসহ মেজর ফারুকী ও মেজর মীর্জা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা খুব আনন্দ ও হাসাহাসি করছিলেন এবং অতি খুশীতে মিষ্টি খাচ্ছিলেন। মেজর মনোয়ার হোসেন আওয়ামী লীগের পতন ও বাঙ্গালীদের দমন করার কথায় মেতে ছিলেন। তাঁরা আমাকেও মিষ্টি খেতে বলেন। তখন আমি অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমার মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও একটা মিষ্টি খেলাম, তারপরই আমি শহরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য মেজর মনোয়ার হোসেনের নিকট কয়েক ঘণ্টার জন্য বাইরে যাবার অনুমতি চাই। কিন্তু তিনি আমাকে বাইরে যাওয়া থেকে বঞ্চিত করেন এবং বলেন, শহরে অনেক বাঙ্গালী দুষ্কৃতিকারী মারা গেছে। যেহেতু তুমি বাঙ্গালী, কাজেই তাদের মৃতদেহ দেখে তুমি স্বাভাবিকভাবেই সহ্য করতে পারবে না, কাজেই তোমাকে এখন বাইরে বা শহরে যাবার