পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৯২

লোক উইং সদরের চতুর্দিকহ পরিখা-বিবর ঘাঁটিতে ডিউটিরত। লাইনে হাজির লোক খুব কম, আবার ওদের সঙ্গে উঠাবসা-শোয়ার ব্যবস্থা। তথাপি কমাারগণ নির্দেশ মাফিক আপন-আপন গ্রুপের লোকজনদের গোপনে ইশারায় সব বলিয়া দিলেন। অতি সতর্কতার সহিত প্রস্তুতি চলিল। প্রচুর উৎসাজ-উদ্দীপনা থাকা সত্ত্বেও অনেককেই এই সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িতে দেখা গেল। তবে মঙ্গলময়ের আশীর্বাদপুষ্ট হইয়া সুবেদার হাফিজ খুবই সক্রিয় ছিলেন। তিনি উইং-এর পুরা রক্ষাব্যূহ ঘুরিয়া প্রতিটি মরিচায় যাইয়া প্রতিটি বাঙ্গালীর কাছে পৌঁছাইয়া দিলেন অপারেশনের নির্দেশ এবং বাহিরে পেট্রল পার্টির সাথে যোগাযোগ রাখা হইল। খোদাকে ধন্যবাদ কেহ সেই দিন না বলে নাই, যদিও মনে মনে ঘাবড়াইয়া গিয়াছিল অনেকেই।

 রাত ১০টা ১৮ মিনিট। চারিদিকে অন্ধকার, থমথমে ভাব। সুবেদার হাফিজের হস্তস্থিত ঠোট্ট স্টেনগানটা হঠাৎ গর্জিয়া উঠিল। মেজর আর ক্যাপ্টেনের দেহরক্ষীদলের অধিনায়ক হাবিলদার মোহাম্মদ জামান বুকে গুলিবিদ্ধ হইয়া পরকালের যাত্রী হইল তাহারই গার্ড-রুমের বিছানায়। ইশারা বুঝিয়া পর মুহূর্তে আরও অনেক ক্ষধার্ত হাতিয়ার গর্জিয়া উঠিল একসঙ্গে। বেশ কয়জন পশ্চিমা পরপারর যাত্রী হইল। আমাদের লোক ‘জয় বাংলা' ধ্বনি দিয়া বিজয়বার্তা ঘোষণা করিল। থামিয়া সারা রাত ধরিয়া ফায়ার চলিল, যদিও আমার মতে আদৌ এর দরকার ছিল না। ঐদিকে গোলাগুলির ফাঁকে এক সময়ে বর্ডার কোম্পানীগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হইল সব পশ্চিমা খতম করতঃ সামান্যসংখ্যক লোক পিছনে রাখিয়া অধিকাংশকে ঠাকুরগাঁ পাঠাইয়া দিতে। রাতের অন্ধকারে তেতলা দালান, বাসাবাড়ী ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে চতুর্দিকে লোক ছড়াইয়া ছিল, তাই একেবারে পশ্চিমা নিধন পর্ব শেষ হইল না। অধিকন্তু নানা সুযোগে নানা জায়গায় কিছুসংখ্যক পশ্চিমা হাতে অস্ত্র তুলিয়া নেয়। তাই আরও কিছুটা সময় লাগিল আমাদের। এই এলোপাতাড়ি পাতলা ফায়ারের ভিতর দিয়া আমাদের বাঙ্গালী পরিবারগুলিকে শহরে স্থানান্তরিত করিয়া দিলাম। শহরবাসীরা প্রথমে গোলাগুলির শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া পড়িয়া পড়িলেও অনতিবিলম্বে আমাদের বিজয় সংবাদ শ্রবণে হাজার হাজার মুক্তিপাগল মানুষ সমবেত কণ্ঠে 'জয় বাংলা' ধ্বনিসহ বিভিন্ন শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করিয়া তুলিল এবং তাহারা বিভিন্ন প্রকারে আমাদের সাহায্য করিতে লাগিল। সেই দিন ভোররাত্রে বাঙ্গালী ক্যাপ্টেন নজীর আহমদ অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম ও তাহার স্ত্রীকে নিয়া ছদ্মবেশে পলায়ন করিতে থাকেন সম্ভবতঃ সৈয়দপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পদব্রজে সামান্য কিছু দূর যাওয়ার পরই ক্ষীপ্ত জনসাধারণের হাতে মারা পড়েন। ওদিকে সেইদিন ভোররাত্রেই ৮-উইং হইতে আসা সুবেদার আতাউল হক শহীদ হন। এই বিপ্লবে তাহার ভূমিকা অতি প্রশংসনীয়। তাঁহারই যোগসূত্র ক্রমে সেই রাত্রে ই হাজার হাজার লোক টাউনে বাহির হইয়া পড়ে এবং তাহারা আমাদের সহযোগিতা পাইয়া আবার শতগুণ উৎসাহে মাতিয়া উঠে এবং আমাদের সাহায্যার্থে আগাইয়া আসে।

 ২৯শে মার্চ সকালবেলা সামান্য গোলাগুলি চলিতে লাগিল। অবশিষ্ট খানরা দালানকোঠায় থাকিয়া ফায়ার করাতে তাহাদিগকে কাবু করা গেল না। আমরা ছাত্র, জনসাধারণ ও স্থানীয় বিভিন্ন বিভাগের নিম্নপদস্থ কর্মচারী বিশেষ করিয়া ওয়াপদা বিভাগের লোকদের সহায়তায় ছাউনি হইতে আমাদের প্রয়োজনীয় সব হাতিয়ার, গোলাগুলি ও অন্যান্য বহু জিনিসপত্র অন্যত্র সরাইয়া নিলাম।

 ২৯শে পার হইয়া ৩০শে মার্চের সকাল। আমি সুবেদার মতিউর রহমানকে এক প্লাটুন লোকসহ ঠাকুরগাঁ হেডকোয়ার্টারকে শত্রুমুক্ত করার নির্দেশ দিলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার দলবল নিয়া অগ্রসর হইলেন কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টার পর খানদের ব্যূহ ভেদ করিতে না পারিয়া ফেরত চলিয়া আসিলেন। তখন সুবেদার হাফিজ তাহার কোম্পানীর কিঞ্চিদধিক এক প্লাটুন লোক নিয়া ঝাঁপাইয়া পড়েন এবং বিকাল প্রায় তিনটা নাগাদ তেতালা দালানের শেষ দুশমনটি পর্যন্ত খতম করিয়া তাহা পরিষ্কার করেন। তাহারই আদেশে প্লাটুন কমাণ্ডার বজল আহমদ চৌধুরী একদল লোক নিয়া উইং অধিনায়কের বাসভবন মুক্ত করেন। মেজর হোসেন এই সময়ই নিজ বাসভবনে নিহত হন। একই সময় যুগপৎ আক্রমণ করিয়া নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান পাক আর্মির গেরিলা সুবেদার ও তাহার সঙ্গীদের খতম করিয়া জেসিও মেস পরিষ্কার করেন। পাবলিকের সহায়তায়