পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৯৬

চাপে ঐ স্থানও ছাড়িতে হইল। লোকের মনোবল যথেষ্ট ছিল কিন্তু ভারী অস্ত্র না থাকায় আবার সরিয়া আসিতে হইল।

 আমরা আবার ভাতগাঁয়ের পুলের নিকট শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করিলাম। মেজর এম. টি, হোসেনসহ কর্নেল কোন কাজে আসিল না। আমি ব্যানার্জী সাহেবকে বলিয়াছিলাম যে, ভাতগাঁয়ের পতন হইলে আমাদের লোকজনের মনোবল নষ্ট হইবে এবং ঠাকুরগাঁ শহরকে রক্ষা করা সম্ভব হইবে না। তাই যেভাবেই হউক ভাতগাঁওকে রক্ষা করিতে হইবে। আমরা দুইজনে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করিবার জন্য অনেক টেষ্টা নিলাম কিন্তু কিছুই হইল না। বিহারের প্রধানমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুর আমাদিগকে যে কোন সাহায্য দিতে আশ্বাস দিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা পাইতে অনেক দেরী হইয়া গেল।

 ১৩ই এপ্রিল ভাতগাঁয়ে সম্মুখ সমরে না আসিয়া খান সেনারা রাস্তা ধরিয়া পিছন দিক হইতে আক্রমণ করিবার পরিকল্পনা নিল। শত্রুদের পরিকল্পনা আমরা অনেকটা বুঝিতে পারিলাম। খানসামায় তখন আমাদের কোন লোক ছিল না। তাই আমরা তাড়াহুড়ো করিয়া গোপনে সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে এক কোম্পানী সেখানে পাঠাইলাম। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় তাহার কোম্পানী বীরগঞ্জ হইতে পদব্রজে অগ্রসর হইয়া খানসামায় পৌঁছে। শত্রুসেনারা দুইটি কোম্পানী যখন নদী পার হইতেছিল তখন তাহারা সুযোগ বুঝিয়া তাহাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাইয়া তাহাদের ৮ বালুচ ডি কোম্পানীকে সম্পূর্ন রূপে পর্যদুস্ত করিয়া দেয়। প্রচুর হতাহত করা ছাড়াও তাহারা দুশমনের নিকট হইতে ১০ গাড়ী মালামাল হস্তগত করে যাগার মধ্যে অনেক গোলাবারুদ, ৭৫টি বিছানা, প্রচুর রেশন, পাকের সরঞ্জাম, একটি অয়ারলেস সেট, একটি মোটর সাইকেল ও আরও বিবিধ দ্রব্যাদি ছিল। সুবেদার হাফিজের বলিষ্ঠ নেতৃত্বই ছিল এই কোম্পানীর সাফল্যের কারণ। শত্রুর এই আক্রমণ প্রতিহত করিয়া পাল্টা তাঁহাদের যে ক্ষতি সাধন করা হইয়াছিল তাহাতে শত্রুর মনোবল যথেষ্ট ক্ষুন্ন হইয়া যায়, ফলে তিনদিন পর্যন্ত শত্রুদের তরফ হইতে আর কোন সাড়াশব্দ ছিল না এবং পশ্চাৎ আক্রমণ হইতেও আমাদের ঘাঁটি মুক্ত রহিল।

 ১৭ই এপ্রিল আমি বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের তিন সদস্যের একটি দলকে নিয়া ভোর পাঁচটায় রওয়ানা হই সীমান্তের দিকে তাহাদিগকে গন্তব্য স্থানে পৌঁছাইয়া দিতে। মেজর এম, টি, হোসেন সাহেব থাকিলে রণাঙ্গনের দায়িত্ব নিয়া। আমি প্রায় দুপুর তিনটায় রুহিয়া পৌঁছি এবং ঠাকুরগাঁও কমাণ্ড পোস্টের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করিবার চেষ্টা করি কিন্তু কোন সাড়া না পাইয়া আমার মনে সন্দেহ জাগে এবং আমি তাড়াতাড়ি পঞ্চগড় কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে চলিয়া আসি। এখানে আমাদের অল্পসংখ্যক লোককে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞেসাবাদে জানিতে পারি ভাতগাঁও ঘাঁটিতে প্রচণ্ড সংঘর্ষের ফলে আমাদের লোকজন ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িয়াছে। মেজর এমটি হোসেনের কোন খবর নাই, তবে শুনিলাম, তিনি একটি বড় বাস ও একটি জীপ নিয়া অর্ধ লক্ষ টাকাসহ ভারতে চলিয়া গিয়াছেন হাতিয়ার ও গোলাবারুদ আনার জন্য। কিন্তু এখানে উল্লেখ্য যে, দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তিনি আর দেশে ফিরিয়া আসেন নাই। যাহাই হউক ভাতগাঁও ঘাঁটির নেতৃত্বে ছিল নায়েক সুবেদার আব্দুল খালেকের উপর। তাহার নিকট সমস্ত ঘটনা জানতে পারিলাম। তিনি জানাইলেন শত্রুরা সকাল আটটার সময় প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ চালায় ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে। তাহারা প্রথমে কান্ত মন্দিরের পাশ দিয়া ঢুকিয়া সোজা বীরগঞ্জ দখল করিতে চেষ্টা করে কিন্তু আমাদের জোয়ানদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তাহা ভঙ্গুল হইয়া যায়। এরপর শত্রুরা শক্তি বৃদ্ধি করতঃ দ্বিতীয় দফা আক্রমণ করে। আমাদের বাহিনীও অসীম সাহসিকতার সঙ্গে বাধা দেয় এবং প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরিয়া তুমুল সংঘর্ষের পর আমাদের লোকজন ছত্রভঙ্গ হইয়া অনেকে দলত্যাগী হইয়া ভারতের দিকে চলিয়া যায় এবং অনেকে পিছনে পচাঁগড় হইয়া জমায়েত হইতে থাকে। এখানে আমাদের ৩ জন শহীদ হন। তাহারা বীরবিক্রমে লড়াই করিয়া শত্রুপক্ষের অন্ততঃ ২৫/৩০ জনকে নিহত ও ১৫/২০ জনকে আহত করেন। সিপাহী আবদুল মান্নান, সিপাহী গুল মোহাম্মদ ভূঞা ও হাফিজ আবদুর রহমান এই যুদ্ধে অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছেন। আহতদের মধ্যে সিপাহী আবদুল মন্নান আহত অবস্থায় শত্রুর হস্তে বন্দী হয়-