পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩২৫

 ১লা এপ্রিল ভোর ছটার মধ্যে আমরা রাজশাহী শহরের অদূরে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করি। আমাদের পেট্রল বাহিনী নিয়োগ করি খবরাখবর আনার জন্য। আমার পূর্বদিকে মেজর রশীদের নেতৃত্বে যে সমস্ত লোকজন পাঠানো হয়েছিল তাদের সাথেও যোগাযোগ করি এবং তাদেরকে বলা হয় যেন তারা সারদা থেকে অগ্রসর হয়ে রাজশাহীর পূর্বদিকে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে।

 এদিকে আমার সশস্ত্রবাহিনীর সংখ্যা পুলিশ; আনসার মুজাহিদ; ছাত্র; ইপিআর মিলে একহাজারের ওপরে পৌছে যায়। শত্রুবাহিনী রাজশাহীর চারিদিকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ আরো শক্তিশালী করে এবং তাদের স্বয়ংক্রিয় ভারী অস্ত্র প্রধান পথে মোতায়েন করে। শত্রুবাহিনী আমাদের শক্তি এবং সংখ্যা নির্ণয় করতে সক্ষম হয় এবং তাদের জংগী বিমান ঢাকা থেকে সাহায্যের জন্য আসে। ১লা এপ্রিল থেকে ৫ই এপ্রিল প্রত্যহ দু'একবার করে বিমান হামলা চলে; কিন্তু রাজশাহীর চতুর্দিকে আম্রকুঞ্জ থাকায় এবং তার নীচে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি হওয়ায় শত্রুবাহিনীর বিমান গুলো আমাদের অবস্থান নির্ণয় করতে পারেনি এবং আমাদের বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তবে বেসামরিক অনেক লোকজন মারা যায় এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।

 ৩রা এপ্রিল ভারত থেকে বিএসএফ-এর একজন লেঃ কর্নেল সেন এবং মেজর ত্রিবেদী নামে দুজন অফিসার আমার সাথে দেখা করতে আসেন এবং আমার কি সাহায্যের প্রয়োজন জিঞ্জেস করেন। আমি তাদেরকে কিছু আর্টিলারী ফায়ার-এর সাপোর্ট দিতে বলি তাদের সীমানা থেকে। সীমান্ত নিকটে থাকায় এটা সম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি জানালেন যে, এটা তারা দ্বারা সম্ভব নয়; তবে তিনি কর্তৃপক্ষকে বলবেন তবে যদি কোন রাইফেল এলএমজি চান দিতে পারি। কিন্তু ইমি তাকে বললাম যে; এখন আমার কাছে ১২টা ৩ ইঞ্চি মর্টার;একশোর উপর এলএমজি-এমজি এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ আছে। তাই আমার এগলো দরকার নেই। বিমান হামলা মোকাবেলা করার জন্য ভারতীয় সীমান্ত থেকে কিছু বিমান বিধ্বংসী কামান দিয়ে সাহয্য করতে অনুরোধ করলাম। আমি তাকে আরো বললাম যে ৬ই এপ্রিল আমি রাজশাহী আক্রমণ করব বলে স্থির করেছি; সে দিন যেন আমাকে আর্টিলারী ফায়ার সাপোর্ট দেয়া হয়।

 রাজশাহী যুদ্ধঃ আমার পরিকল্পনা ছিল শহরের দক্ষিন দিক থেকে আক্রমন চালানো এক ব্যাটালিয়ন নিয়ে। আর কিছু লোক উত্তর পশ্চিম দিকে শত্রুকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কিছু গোলাগুলী করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে ব্যাটালিয়নকে দক্ষিণ দিকে মুভ করিয়ে আনি এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নিই; ইদিকে জানতে পারলাম বন্ধুরাষ্ট থেকে সাহায্য পাবার কোন সম্ভাবনা নেই এবং তা কখনো আসেনি।

 আক্রমন শুরু হয় ৬ই এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টা-৭টার দিকে। শত্রুবাহিনী আমাদের উপর প্রবল গোলাবর্ষণ এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে গুলি বর্ষন করতে শুরু করে। অদম্য সাহস মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মুখে ঠেলে নিয়ে যায় এবং শত্রুদের ব্যূহ ভেদ করে তারা শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। প্রায় চার ঘণ্টা লড়াইয়ের পর রাজশাহী শত্রুমুক্ত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহীর চতুর্দিকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী করে ফেলে। পশ্চিম সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সংখ্যক লোক নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ৩০/৩৫ জন হতাহত হয়। রাজশাহী পুলিশ লাইন প্রভৃতি জায়গা থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করি। রাজশাহী পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে প্রায় তিন হাজার অস্ত্র তিন লাখ গুলি উদ্ধার করা হয়। বাকি শত্রুবাহিনী তাদের ছাউনি পশ্চাদপসরণ করে এবং সেখানে একত্রিত হয়ে আরো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বৃহা তৈরি করে। ছাউনির চারিদিকে মাইন পুর্তি রাখে এবং কাঁটা তারের বেড়া দিতে শুরু করে। শহরের লোকের মনে উল্লাসের সৃষ্টি হয়। এবং আমাদের পূর্ববর্তী কর্মসুচী ঐ ছাউনি দখল করার কাজে নিযুক্ত হয়। এদিকে শত্রুবাহিনী বিমান হামলা আমাদের উপর অব্যাহত থাকে।

 ৭ই এপ্রিল থেকে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত আমরা শত্রুবাহিনীর ছাউনির অতি নিকটে চতুর্দিকে থেকে ঘিরে ফেলি এবং ছাউনির ৩০০/৪০০ গজের মধ্যে পৌছে যাই। কিন্তু শত্রুবাহিনীর মাইন এবং কাঁটা তারের বেড়া ডিংগিয়ে ভিতরে গিয়ে আক্রমণ চালানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। শত্রবাহিনী সমস্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাঙ্কবিধবংসী