পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৩৪

আমরা সেনানিবাসের কিছু জায়গা দখল করে নেই। এই অভিযানে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের অধকাংশ‍ই নিহত হয়।

 রাজশাহী দখলের পরই খবর আসে যে ঢাকা থেকে বিপুল সৈন্য আরিচাঘাট- নগরবাড়ি হয়ে রাজশাহীর দিকে আগ্রসর হচ্ছে। তাদের পথে বাধা দেয়ার জন্যে আমাদের কিছু লোক-আনসার; মোজাহিদ; পুলিশ ঐদিকে এগিয়ে যায়। নগরবাড়িতে আমাদের লোকের সাথে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। আমাদের লোক পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানীদের রাজশাহী পৌছা পর্যন্ত রাস্তার কয়েক জায়গায় আমাদের লোকের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। সংখ্যায় তারা অধিক থাকায় বহু হতাহতের পরও তারা রাজশাহী পৌছে যায়- বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের সুশিক্ষিত গোলন্দাজ বাহিনী তাদের অনেক গাড়ী ধ্বংস করে। তাদেরও অনেক হতাহত হয়। ১৩ই এপ্রিল শেষ রাতে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর মরণপণ আক্রমন চালায়। আর্টিলারী; পদাতিক এবং বিমান হামলা চলে সম্মিলিতভাবে। তাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা আত্মরক্ষার জন্য পিছু হটতে বাধ্য হই।

 পুনরায় আমরা সমবেত হই-চাঁপাইনবাবগঞ্জে। গোদাগাড়ীতে পুনরায় ডিফেন্স নিই। ২২শে এপ্রিল ভোর বেলায় পাকিস্তানীরা আমাদের উপর হামলা চালায়। এখানে পাকিস্তানীদের প্রায় ১৫০টি কনভয় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমন চালায়। পরপর কয়েকবার আমাদের উপর পাল্টা আক্রমন হয়। আমাদের বহু লোক এখানে শহীদ হয়।

 ২৩শে এপ্রিল ভোরে আমরা পদ্মা নদী পার হয়ে হাকিমপুর, পোলাডাঙ্গা এবং সাহেবনগর চরে গিয়ে সমবেত হই। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশে সমস্ত লোক পোলাডাঙ্গা ক্যাম্পে একত্রিত হয়।

কানুপুরের যুদ্ধ[১]

 রাজশাহী-একাত্তরের ২৯শে এপ্রিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্র আসাদ আহমদ বায়রনের নেতৃত্বে একদল গেরিলা নবাবগঞ্জ মহকুমার শিবগঞ্জ থানাধীন পাগলঅ নদীর ওপার থেকে নদী পার হয়ে কানুপুর যাত্রার জন্য তৈরি হয়। রাত তখন নয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট; দুর্লভপুর গেরিলা শিবির থেকে বায়রন তার দল নিয়ে যত্রা শুরু করে। সাথীদের সকলের চোখে মুখে যেন কিছুটা নৈরাশ্যের ছাপ। হয়তো মনে হচ্ছিল এই দুঃসাহসিক অপারেশন বুঝি কেউ আর ফিরে আসবে না। পরক্ষণেই তাদের আবার মনে হয়েছে যেমন করেই হোক তাদের এ অপারেশনে সাফল্যলাভ করতেই হবে। কারণ দখলদার নরঘাতক ইয়াহিয়া বাহিনীর কবল থেকে মুক্তির আশায় বাংলাদেশের মানুষ দিন গুনছে। দুটিমাত্র ছোট নৌকা তাদের সম্ভল; অস্ত্রশস্ত্র নৌকায় রাখা আর গেরিলারা নৌকায় ভেসে চলেছে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলেছে পশুহত্যার উল্যাসে। রাত পৌনে এগাটা। শেষ হলো জলে ভাসা। কানুনপুরের কাছে এক আখক্ষেতে নৌকা রাখা হয়। নৌকায় রাখা অস্ত্র তারা হাতে তুলে নেয়। আবার শুরু হয় যাত্রা। এক বুক পানি ভেঙ্গে এগিয়ে চলেছে। খানিকটা দূর ঘুরে কানুনপুর গ্রামটাকে পেছনে ফেলে এক আম বাগানে প্রবেশ করে। সেখানেই প্রত্যেককে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হয়। তারা যখন আম বাগান প্রবেশ করে তখন শিবগঞ্জের খানসেনাদের ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ভেসে আসছিল মুহুর্মুহু গোলাগুলির আওয়াজ। পদপ্রদর্শক ছিল ১১ বছরের একটি বালক; এর নাম জানা যায়নি। প্রথমে যদিও এই বালকের ওপর ভরসা করা যায়নি; কিন্তু সে ভুল ভাঙতে খুব দেরি হয়নি। সে অত্যন্ত গেরিলাদের এগিয়ে নিয়ে গেল-পাঞ্জাবী আর রাজাকারদের ট্রেঞ্চ ও বাংকারগুলো খুব কাছ থেকে দেখিয়ে দিল। ক্রলিং করে গিয়ে পাহারারত রাজাকারকে কিছু করার সুযোগ না দিয়ে গলা টিপে হত্যা করে অস্ত্র কেড়ে নেয় এগারো বছরের বালকটি। এরপর শুরু হয় গেরিলাদের কাজ।


  1. দৈনিক বাংলা ২১শে মার্চ ১৯৭২-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত