পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৭১

রাইফেল আর এই সতেরখানা, মোট একশখানা। মুক্তিবাহিনী এখন একশটি অস্ত্রের অধিকারী। অস্ত্রের সাথে সাথে বেশকিছু বুলেটও পাওয়া গেছে। তাই দিয়ে অনেকদিন কাজ চলবে। একটা নিরালা জায়গায় ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে এক মাসের ট্রেনিং দওয়ার ব্যবস্থা করা হতে লাগল। বহু খোঁজাখুজঁরি পর ট্রেনিং দেওয়ার জন্য একজন প্রাক্তন সৈনিকের সন্ধান পাওয়া গেল। অনেক সাধ্য-সাধনাকরে রাজী করান গেল তাকে। আপাতত প্রথম রাউণ্ডে তাকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি ক'টা গ্রাম একেবারে জনমানবশূন্য। ট্রেনিং এর জন্য গোপন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করবার মত নিরালা জায়গাও মিলল। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল এই যে, পঞ্চাশটি তরুণ এক মাস কাল ধরে ট্রেনিং নেবে, তারা খাবে কি? এই দুঃসময়ে যারা তাদের অর্থ দিয়ে খাদ্য দিয়ে সাহার্য্য করতে পারত, তাদের মধ্যে অনেকেই গ্রাম থেকে পালিয়ে বিল অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহের জন্য মুক্তিফ্রণ্ড অর্থ সাব-কমিটি ও খাদ্য সাব-কমিটি গঠন করেছিল। তাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না বটে কিন্তু এই কঠিন সময়ে যথাশক্তি চেষ্টা করেও তারা তাদের দায়িত্ব পূর্ণ করে উঠতে পারছিল না। তা সত্ত্বে এক মাস ধরে এই ট্রেনিং চলল। প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবকের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও দৃঢ়সংকল্প এই অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়েছিল। সত্য কথা বলতে কি, তারা অধিকাংশ সময়ে আধ-পেটা খেয়ে এবং সময় সময় না খেয়েও এই সামরিক ট্রেনিং নিয়ে চলেছিল।

 প্রাথমিক প্রস্তুতি সমপন্ন করে মুক্তিবাহিনী এবার কাজে নামল। তারা প্রথমে সমাজ-বিরোধী শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযানে নামল। তারা এই সমস্ত দালাল ও দুর্বৃত্তদের নামের একটি কালো তালিকা তৈরী করে নিয়েছিল। পর পর কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল। ১২ই জুন তারিখে মুক্তিবাহিনী গইলা অঞ্চলের দুইজন কুখ্যাত দালালের বাড়িতে হামলা করল। এদের হাতে প্রথম বাড়িতে আরজান ও তার দুই ছেলে এবং দ্বিতীয় বাড়িতে গইলার প্রতাপশালী চেয়ারম্যান আফতাবুদ্দিন মুন্সী নিহত হোল।

 এইভাবে বিভিন্ন স্থানে দালাল হত্যার পর সারা অঞ্চল সাড়া পড়ে গেল। লোকে বুঝল, সামরিক সরকার মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে তাদের দালালদের রক্ষা করতে অসমর্থ। অবস্থা দেখে অন্যান্য দালালরাও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তাদের অনেকের কাছ থেকে মুক্তিফ্রণ্টের নেতাদের নামে চিঠি আসতে লাগল। কালো তালিকার কথাটা সকলের কাছেই প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। আতঙ্কগ্রস্ত দালালরা তাদের সেই সমস্ত চিঠিতে এই মিনতি জানাত যে, তাদের নাম যেন ওই কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিফ্রণ্ট যদি তাদের রেহাই দেন, তাহলে তারা মুক্তিফ্রণ্টকে অনেট টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করবে।

 এইভাবে দালালদের দমন করে মুক্তিবাহিনী এবার তাদের আসল কাজে নামল।

 ইতিমধ্যে একটা অনুকূল যোগাযোগের ফলে মুক্তিবাহিনীর শক্তি আশাতীতরূপে বেড়ে গিয়েছিল। আপনা থেকে একটা বিরাট সুযোগ তাদের হাতে এসে গেল। মুক্তিফ্রণ্ট তাদের সংগ্রাম শুরু করবার কিছুটা আগে আর একটি ছোট দল অনুরূপ আদর্শ নিয়ে কার্যক্ষেত্রে নেমে গিয়েছিল। দলটি ছোট হলেও গুণের দিক দিয়ে উন্নত পর্যায়ের। দলের নেতার নাম হেমায়েতউদ্দীন। হেমায়েতউদ্দীন প্রাক্তন সৈনিক। ২৫-এ মার্চ ঢাকায় যখন প্রথম আক্রমণ শুর হোল, সেই সময় হেমায়েতউদ্দীন ঢাকাতেই ছিলেন। তার কিছু আগেই তিনি কি করে একটা মেশিনগান ও একটা সাবমেশিনগান যোগাড় করে নিয়েছিলেন, একমাত্র তিনিই তা জানেন। এ ছাড়া কয়েকটি রাইফেলও তাঁর হাতে এসে গিয়েছিল। ঢাকার হামলার পর এই দুটি ভারী অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে হেমায়েতউদ্দীন চলে এলেন ফরিদপুরে। এখানে এসেই তিনি জঙ্গী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে নেমে গেলেন। এই উদ্দেশ্যে তাঁর ছোট্ট দলটি গড়ে উঠল। তাঁর এই বাহিনীতে মাত্র ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। ৪ জন প্রাক্তন সৈন, আর ৩ জন বেসামরিক লোক। মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রাথমিক অবস্থায় অস্ত্রবলের দিক থেকে এরা ছিল খুবই শক্তিশালী। তাছাড়া এই দলে ছিল যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত ৪ জন সৈন্য। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি দলের নেতা হেমায়েতউদ্দীন। পরিচালনা শক্তি, বুদ্ধি ও সাহসের দিক দিয়ে তাঁর তুলনা কমই মেলে। মুক্তফ্রণ্টের বহু ভাগ্য, এক বন্ধুর মধ্যবর্তিতায় তাদের সঙ্গে হেমায়েতউদ্দীনের যোগাযোগ ঘটল এবং কিছুদিনের মধ্যে এই দুই দল