পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৯

 আমাদের বীর সিপাহীরা ওদের মিথ্যা ভাঁওতায় কান না দিয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধ করছিলো ওদের। কিন্তু আমাদের বীর সিপাহীরা ও আমাদের সকলের গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের অস্ত্রাগারেও তখন প্রবেশ করার কোন উপায় ছিলো না। সেখানে ওরা গোলাবর্ষণ করছিলো উন্মত্তভাবে। আমি উপায়ান্তর না দেখে পিছু হটতে হটতে পুলিশ লাইনের দক্ষিন দিকে অবস্থিত ঘোড়ার আস্তাবলের পিছনের রাস্তা দিয়ে আমিনবাগের মধ্যে দিয়ে চলে এসে প্রাণ বাচাই। এরপর আমি গ্রামের দিকে গিয়ে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে ঝঁপিয়ে পড়ি।

ঢাকার মিরপুরে প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ মোহম্মদ আঃ সোবহান[১]

ইন্সপেক্টর অব রিজার্ভ পুলিশ

বি-আর-পি, রাজশাহী

২৯-১-৭৪

 আমার ওয়ারলেস সেটটি কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর রাজারবাগ অয়ারলেস কণ্ট্রোল রুম থেকে আর এক বাঙ্গালী পুলিশের কণ্ঠ ঘোষণা করলো, “অল অফিসার্স অফ এণ্ড অ্যাবভ র‍্যাংক অফ ইন্সপেক্টরস উইল প্রোসিড টু দেয়ার কোয়ার্টার্স।” হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালের পশ্চিমের গেটে প্রহরারত বাঙ্গালী পুলিশের ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠ আমার অয়ারলেস সেটে বেজে ওঠার পর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কণ্ট্রোল রুমের অয়ারলেস থেকে সতর্কবাণী পাওয়ার পর আমরা সন্ত্রস্ত হয়ে পরেছিলাম। এরপর বিএসপি, ইন্সপেক্টর সহ সকল পদস্থ বাঙ্গালী পুলিশ অফিসার যারা মিরপুর ও অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন সেকশন ও সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন, অয়ারলেস মারফৎ রাজারবাগ কণ্ট্রোল রুম থেকে উপরোক্ত নির্দেশ পাওয়ার পর সবাই হেড কোয়ার্টারে চলে গেলে আমি আমার এক প্লাটুন (৩৭জন পুলিশ) নিয়ে মিরপুর থানায় গিয়ে উঠি। সেখানে আমি মিরপুরের বিভিন্ন সেকশনে কর্তব্যরত সকল ফোর্সকেই জমায়েত দেখতে পাই। সারা মিরপুরে এ সময় থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো। হঠাৎ পুলিশ (কমিশনার বিল্ডিং) কণ্ট্রোল রুম থেকে আবার অয়ারলেস সেটে বাঙ্গালী পুলিশের কম্পিত কণ্ঠ বেজে উঠলো। সেই কণ্ঠ বলেছিলো- “পাক আর্মি ভারি কামান, ট্যাংক ও মেশিনগান নিয়ে আমাদের কণ্ট্রোল রুম ঘেরাও করে ফেলেছে। ওরা গোলাবর্ষণ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে আমাদিগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য- ওরা ভীষণভাবে ধেয়ে আসছে- তোমরা যে যেখানে থাক এগিয়ে এসো, আমাদের রক্ষা করো, বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও।” সেই কণ্ঠ বলে যাচ্ছিল-“রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকপশুদের হামলা হয়েছে, সেখানেই গোলাগুলি চলছে, আমাদের বীর পুলিশরা লড়ছে, সেখানকার অয়ারলেস বেইচ থেকে আমরা কোন শব্দ পাচ্ছি না, সব নীরব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।” পরক্ষণেই আমরা ঢাকার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশে বৃষ্টির মতো লাইট-বোম উড়ছে। কামান, ট্যাঙ্ক আর গোলাবর্ষণের ভীষণ গর্জন শুনছিলাম, অসংখ্য মানুষের বুকফাটা অসহায় কান্নার রোল ভেসে আসছিলো। অস্থির অধীর ছাত্র জনতা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেই অসংখ্য কামান, ট্যাংক ও গোলাবর্ষণের আগুনের মধ্যে। চোখের সামনে দেখলাম আগুন আর আগুন, জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলছে, রাজধানী ঢাকা জ্বলছে। চোখ ফিরিয়ে মোহাম্মদপুরের আসাদ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানেও ভীষণ গুলি আরম্ভ হয়ে গেছে, বাড়ি ঘর জ্বলছে। সেই ভয়াল ও ভয়ংকর গোলাবর্ষণও আগুনের লেলিহান শিখা আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো, আমাদের ফোর্স সবই মিরপুর থানায় জমায়েত হয়েছিল। অর্ধেকের হাতে ছিল লাঠি আর অর্ধেকের হাতে ছিল সাধারণ রাইফেল আর বিশ রাউণ্ড গুলি। মিরপুর থানায় এভাবে বসে থাকলে সব এক সাথে ওদের ঘেরাওর মধ্যে পড়ে কুকুর-বিড়ালের মতো মরতে হবে ভেবে আমরা আমাদের ফোর্সকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পজিশন নিতে বলি আর আমার সিপাহীদের যাদের হাতে শুধু


  1. মোহাম্মদ আবদুস সোবহান ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আর্মড সাব-ইন্সপেক্টর অব পুলিশ হিসেবে কর্মরত থাকাকালে মিরপুর দশ নম্বর সেকশনে জরুরী টহলে গিয়েছিলেন।