পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২২

মেহনতী মানুষ আর গ্রামের কৃষক পর্যন্ত জনসাধারণের সমস্ত স্তর থেকে ওরা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। তাই পশ্চিমী শাসক চক্রের জঙ্গী বাহিনী কোন রকম বাছ-বিচার না করে সর্বগ্রাসী আক্রমণ নিয়ে নেমে এসেছিল।

 রাত বারোটার পর ঘড়ি দেখে কাঁটায় কাঁটায় একই সঙ্গে ওরা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল, লালবাগ, পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকে, পুলিশ ব্যারাকে এমনকি থানায় থানায় ফাঁড়িতে ফাঁড়িতে আক্রমণ করে বসলো। সবাই জানে, একমাত্র বাজারবাগ পুলিশ লাইন ছাড়া আর কোন জায়গা থেকে তারা কোনো প্রতিরোধ পায়নি, যেখানে গেছে সেখানেই অবাধে ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেছে। কিন্তু এর ছোট্ট একটা ব্যতিক্রমও আছে। এই খবরটা কিন্তু খুব কম লোকই জানে।

 নবাবপুর থেকে বংশালের রাস্তায় ঢুকলে বাঁয়ে নিশাত সিনেমা হল, ডাইনে দৈনিক সংবাদ অফিস, সেখান থেকে একটুখানি এগিয়ে গেলে বাংশাল ফাঁড়ি। কিছুসংখ্যক সৈন্য মেশিনগান-রাইফেল নিয়ে এই ফাঁড়ি আক্রমণ করতে গিয়েছিল। তারা নিশ্চিন্ত মনে রাত্রির নিঃশব্দতার বুকে আর্মি বুটের খট খট শব্দ হেনে ফাঁড়িটার দিকে এগিয়ে চলেছিল। এখানে কারু কাছ থেকে যে প্রতিরোধ আসতে পারে এমন কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। ভেবেছিল, অবাধে ও স্বচ্ছন্দে তাদের হত্যালীলা চালিয়ে যাবে, একটা প্রাণীকেও রেহাই দেবে না। কিন্তু ফাঁড়িটার কাছে যেতেই এক পশলা বৃষ্টিধারার মতো মেশিনগানের গুলি তাদের অভ্যর্থনা জানাল। ওরা ভীষণ চমকে উঠে পিছিয়ে গেল। এটা কি একটা বিশ্বাস করবার মতো কথা। এক সামান্য ফাঁড়ির জনকয়েক পুলিশ, তাদের এত বড় সাহস হবে! কিন্তু বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না, ওদের মধ্যে কয়েকজন সেই গুলিতে আহত হয়েছে। এরপর ফাঁড়ির ভেতর থেকে পরপর কয়েকবার রাইফেলের শব্দ শোনা গেল।

 এবার দু’পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। বংশালের পথে একটিও জনপ্রাণী নেই। ঘরে ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ। কারো কোন সাড়া-শব্দ নেই, শুধু ঘন ঘন মেশিনগান আর রাইফেলের শব্দে বংশালের পথ আর দুই ধারের বাড়িগুলি থেকে থেকে কেঁপে উঠছিল। সৈন্যরা বেশ একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলো।

 ফাঁড়ির ভেতরে কে কোথায় আছে, কারা কি করছে- কিছুই তারা দেখতে পাচ্ছিল না। অপর পক্ষে অন্ধকার ফাঁড়িটার মধ্যে উপযুক্ত জায়গায় পজিশন নিয়ে প্রতিরোধকারীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছিল। রাস্তার আলোয় সৈন্যদের তারা ভালো করেই দেখতে পাচ্ছিল। ফলে এইবার ওরা বেশিক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে পারলো না, তখনকার মতো সেখান থেকে পৃষ্ঠভঙ্গ দিল।

 ফাঁড়ির মধ্যে প্রতিরোধকারীরা উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলল। আক্রমণকারীদের মধ্যে জনকয়েক সম্ভবত হতাহত হয়েছিল। কিন্তু পশ্চাদপসরণকারী সৈন্যদের তাদের কোনো চিহ্ন রেখে যায়নি।

 ফাঁড়ির পুলিশরা এভাবে একদল সশস্ত্র সৈন্যকে হটিয়ে দেবে, এটা সত্য সত্যই অভাবনীয়। আরও আশ্চর্যের কথা, তারা ফাঁড়ির মধ্যে থেকে মেশিনগান চালিয়েছিল। থানা বা ফাঁড়ির পুলিশদের হাতে কখনো মেশিনগান দেওয়া হয় না। একমাত্র বন্দুক ও রাইফেল তাদের সম্বল। এই সংকট মুহূর্তে এই মেশিনগান কেমন করে তাদের হাতে এলো?

 বংশাল মহল্লার লোকের মুখে এর উত্তরটা আমি পেয়েছি। এটা শুধু ফাঁড়ির পুলিশদের কাজ নয়। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল এই মহল্লারই সুপরিচিত নাদির গুণ্ডা তার কয়েকটি সাগরেদ। যোগ দিয়েছিল বললে কথাটা সঠিকভাবে বলা হবে না। কার্যত এই নাদিরের নেতৃত্বেই নাকি এই প্রতিরোধকে সংঘটিত করে সৈন্যদের হটিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।

 নাদিরের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে ফাঁড়ির পুলিশেরা এ কাজ হাত দিতে সাহস করত না। আর মেশিনগানে? শুধু বংশাল মহল্লা নয়, পাশাপাশি মহল্লার অনেকেই এ কথা শুনেছিল যে সারা শহরের মধ্যে