পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৫৬

জীবনে কোন যুদ্ধেই হারিনি। কিন্তু নাগরপুর থানায় কোন যুদ্ধেই জিতিনি। ১৭ই অক্টোবর আমি নাগরপুর অভিযান করেছিলাম। সেদিন আমার মারা যাওয়ার মতো অবস্থা। কোন রকমে বেঁচে যাই। তারপরও আমি অভিযান চালাই। সেখানেও আমি হেরে যাই। ৩০শে নভেম্বর বেলা প্রায় সাড়ে ১২টায় নাগরপুর থানা দফতরের উপর হামলা করি। আমাদের মনে ছিল প্রচণ্ড উৎসাহ। নাগরপুর থানায় ৬৫জন সৈন্য রয়েছে-তাও মিলিশিয়া। আর আমাদের হল ২৫০ জন যোদ্ধা। ভাবলাম, আজ হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে খানায় উঠবো। কিন্তু পারলাম না। ২টা তিন ইঞ্চি মর্টার, ২টা আড়াই ইঞ্চি মর্টার, ৭/৮টি ২ইঞ্চি মর্টার, ৪টা গ্রেনেড নিক্ষেপকারী রাইফেল আমাদের সাথে। এ ছাড়া রয়েছে ১৯টি লাইট মেশিনগান। জীবনে এত এলএমজি আর কোথাও ব্যবহার করিনী। এছাড়া স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছাড়া কোন সিংগলশট অস্ত্রও আমরা ব্যবহার করিনি। কিন্তু থানাটির অবস্থান ছিল ভারী বিদঘুটে। সম্মুখে ফাঁকা জায়গা। কবার নেয়ার মতো কোন স্থান নেই। ফলে এগোনো যায় না। আর শত্রুরা মরিচা থেকে ফায়ার করছে। আমি ১৫৮ রাউণ্ড ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষণ করি। কিন্তু একটি গোলাও থানার ওপরে ফেলতে পারলাম না। আমি এমন ব্যর্থ আর কোথাও হয়নি। একশ গজ দূর থেকে ৫৪ রাইণ্ড দুই ইঞ্চি মর্টারের ফায়ারও করেছি। কিন্তু একটাও লক্ষ্যস্থলে পড়েনি। ২রা ডিসেম্বর পর্যন্ত হামলা চালালাম। কিন্তু পাক সেনাদের মরিচা থেকে ডিপার্জ করতে পারলাম না। এত প্রস্তুতির পরও সবচেয়ে বেশি ধকল আমার এখানে গেছে। আসল চাইনিজ ৮৩ রেণ্ডিণ্ডিসাইড কিন্তু তার ফ্লাশ প্রোটেক্ট করার জন্য যে কভার থাকে তা নেই। রাউণ্ড ভরলাম ফায়ার করলাম। থানায় শত্রুদের একটা মরিচা ছিটকে উড়ে গেল। কিন্তু আমাকেও ধাক্কা মেরে হাত তিনেক পেছনে ফেলে দিল। আমার মাথার টুপি উড়িয়ে নিয়ে ফেলল প্রায় পনের হাত পেছনে।

 ৩রা ডিসেম্বর পাক বাহিনীর রিইনফোর্সমেণ্ট কণ্টিনজেণ্ট এগিয়ে এলো ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল। কাদের সিদ্দিকী এগিয়ে গেলেন এলাসিন গুদারা ঘাটে পাক বাহিনীকে বাধা দিতে। কিন্তু সময়ের সামান্য হেরফের তিনি গুদারা ঘাটের ওপারে পাক বাহিনীকে বাধা দিতে পারলেন না। পাক বাহিনী এপারে চলে এলো। কাদের বাহিনী সুবিধামত পজিশন নিতে পারলেন না। কাদের সিদ্দিকী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। আবার সবকিছু ঐ এলাকায় সুসংগঠিত হয়ে গেল। ৩রা ডিসেম্বর মধ্য রাতে কাদের সিদ্দিকী ছিলেন কেদারপুরে। শেষ রাতে গোলা আর বোমাবর্ষণের শব্দ শুনতে পেলেন। খানিক পরই মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল বিমান। সঙ্গীদের বললেন কাদের সিদ্দিকী, কাল থেকে নতুন সুখবর হবে। সঙ্গীরা এ কথার অর্থ জানতে চাইলেন। কাদের সিদ্দিকী বললেন, এই যে দেখলে না আমাদের বিমান শত্রুদের উপর আক্রমণ হেনে চলে গেলো। এরকম আঘাত হানলেই কাজ হবে। বাদবাকি আমরা পারব। পরের দিন কাদের সিদ্দিকী নবতর পরিস্থিতিতে সবাইকে সংগঠিত করলেন।

 কাদের সিদ্দিকী নতুন পরিকল্পনা নিলেন ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে যে সেতুগুলো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে তার নিচু দিয়ে যে রাস্তা হয়েছে তাতেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হবে। সেখানে এণ্টি ট্যাংক মাইন বসানো হবে এবং এই মাইন প্রতিরক্ষার জন্য এর চারপাশে বসানো হবে একাধিক এণ্টি পারসোনেল মাইন। প্রতি রাতে এই মাইন বসানোর নির্দেশ দেয়া হল। কাদের বাহিনীর যোদ্ধারা জালের মতো মাইন বিছিয়ে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে কাদের সিদ্দিকী আরেকটি পরিকল্পনা নিলেন, আগামী দুই দিনের মধ্যে টাঙ্গাইল-মযমনসিংহ সড়কের সেতুগুলো ভেঙ্গে ফেলতে হবে। তারপর টাঙ্গাইল দখল করতে হবে। উল্লেখ্য, ২০শে নভেম্বর টাঙ্গাইল দখলের পরিকল্পনা কাদের সিদ্দিকী ছিল। ঢাকা-টাঙ্গাইল এবং টাঙ্গাইল- ময়মনসিংহের সড়কের সেতুগুলো একযোগে ভেঙ্গে ফেলা হবে- মধুপুর থেকে শুরু করে ৯টা সেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওপাশের দায়িত্ব যারা ছিলেন তারা আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে হাত দিতে পারেনি।

 যাহোক, এবার কাদের সিদ্দিকী সেতু ভাঙ্গার জন্যে নতুন করে পরিকল্পনা নিলেন। তিনি ভাবলেন, ঢাকায় এখন শত্রুদের ওপর বিমান আঘাত হানা হবে; সীমান্ত ছেড়ে পাকবাহিনী আসবে না এবং এই সড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেতু ভেঙ্গে পাকবাহিনী যোগাযোগের পথ বিচ্ছিন্ন করে টাঙ্গাইল তিনি দখল করবেন। ৪ঠা